শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ডলার হ্যাকিংয়ের চক্র চিহ্নিত

একাধিক দেশের ব্যাংক কর্মকর্তা ও জুয়াড়ি জড়িত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডলার হ্যাকিংয়ের চক্র চিহ্নিত

বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া অর্থের সঙ্গে জড়িত চক্রের নাম ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। পুরো বিষয়টির সঙ্গে হ্যাকার ছাড়াও অন্তত একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র এবং ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন এ-সংক্রান্ত তদন্তে সংশ্লিষ্টরা। তবে আরও তথ্য উদ্ঘাটন এবং অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার স্বার্থে এখনই মুখ খুলতে চাইছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা আশা করছেন, যেভাবে রহস্য উন্মোচন হচ্ছে তাতে খুব শিগগিরই রিজার্ভের অর্থ হ্যাকের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রটির মুখোশ উন্মোচন হবে। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের সহযোগিতাও চেয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে ফিলিপিন্সের পত্রিকা ইনকোয়েরার দাবি করেছে, ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স হিসেবে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্সে আসে ৫ ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক ও ওয়েলস ফারগো ব্যাংকের মাধ্যমে রিজাল ব্যাংকে এ অর্থ পাঠানো হয়। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের আন্তর্জাতিক সংকেত (সুইফট কোড) ব্যবহার করে ফিলিপিন্সের ব্যাংকে তহবিল স্থানান্তরের বার্তাও পাঠায় মার্কিন ব্যাংকগুলো।

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে সঞ্চিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সন্দেহভাজন ছয়জনকে শনাক্ত করেছে ফিলিপিন্সের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)। যে ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে তারা হলেন— মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভারজারা, এনরিকো তিয়োডোরো ভাসকুয়েজ, উইলিয়াম সো গো ও কাম সিন অং (কিম অং)। এখন সন্দেহভাজনদের আটকের চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে একজনের ছবিও প্রকাশ করেছে দেশটির স্থানীয় পত্রিকা ডেইলি ইনকোয়ার। ফিলিপিন্সের একটি আদালত ওই পাঁচ ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ছয়জনের সংশ্লিষ্টতার সব অ্যাকাউন্ট ছয় মাসের জন্য জব্দ করার আদেশ দিয়েছে। এ ছাড়া উইলিয়াম সো গোর কোম্পানি সেঞ্চুরিটেক্স ট্রেডিংয়ের সব ব্যাংক হিসাবও জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ক্রুজ, লাগ্রোসাস, ভারজারা, ভাসকুয়েজ ও গো এমন কোনো আয়ের উৎস দেখাননি যা তাদের অ্যাকাউন্টে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় পেয়েছেন। এএমএলসির তদন্ত অনুযায়ী, সুইফটের (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) মাধ্যমে একটি অননুমোদিত পেমেন্ট ইস্যু করা হয়েছে, যাতে বড় অঙ্কের অর্থ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানায়নি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন কাউকে চিহ্নিত করার বিষয় আমরা জানি না। এখন আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি কীভাবে টাকা উদ্ধার করা যায় তার ওপর। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, বিষয়টিতে কারা জড়িত তা খুঁজতে ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। আমাদের সঙ্গে তাদের সমঝোতা আছে। পুরো টাকাই উদ্ধার করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কনসাল নিয়োগ করে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। সে অনুযায়ী কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, হ্যাককৃত অর্থ কীভাবে উদ্ধার করা যায় তা নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল আগামী সপ্তাহে ফিলিপিন্স যাবেন। তারা ফিলিপিন্সের অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এএমএলসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি ইস্যু সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্সের এ যৌথ তদন্ত দলের পাওয়া তথ্য একে অন্যকে শেয়ার করা হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং অর্থ উদ্ধারের ঘটনা যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয় সে জন্য প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করতে চাইছেন না সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানান, এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে চিহ্নিত অ্যাকাউন্টধারী ছাড়াও এ ঘটনায় ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং এ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন বলেও সন্দেহ করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সন্দেহভাজন যে ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) এদের মধ্যে পাঁচজনেরই অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ওই পাঁচ অ্যাকাউন্টেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার এনেছিলেন হ্যাকাররা। এরই মধ্যে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের মাকাটি সিটির জুপিটার স্ট্রিট শাখায় যে পাঁচটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা সরানো হয় সে অ্যাকাউন্টগুলো খোলার জন্য ওই ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ ছিল বলে জুপিটার স্ট্রিট শাখার ম্যানেজার জানিয়েছেন। তবে ব্যাংকটির ওই শাখার প্রধান নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও আইনের হাত থেকে রেহাই পাবেন না বলে জানা গেছে। কারণ অ্যাকাউন্টগুলো খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং অনুযায়ী ‘নো ইউর কাস্টমার বা তোমার গ্রাহককে ভালোভাবে জান’ এ নীতি না মানার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। আগামী ১৪ মার্চ ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটিতে বিষয়টির শুনানিতে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে।

হ্যাক করা অর্থ নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে একাধিক দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। হ্যাক করা অর্থ সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে সেটি ফিলিপিন্সের মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়। তারপর এ অর্থ রিজাল ব্যাংকের চীনা বংশোদ্ভূত এক ফিলিপিন্স নাগরিকের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। তিনি ওই অর্থ তুলে নিয়ে যান দুটি ক্যাসিনোতে— সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো ও সিটি অব ড্রিমস অ্যান্ড মাইডাসে। সে অর্থগুলোকে জুয়ার চিপস (বাজির কয়েন) হিসেবে রূপান্তরিত করে বাজি ধরার উপযোগী করা হয়। আর শেষ পর্যন্ত আবার সেগুলোকে নগদ অর্থে রূপান্তরিত করে হংকংয়ের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তসংশ্লিষ্টদের ধারণা, হ্যাক করা অর্থ দেশের বাইরে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই ক্যাসিনোর সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে জুয়া খেলার উদ্দেশ্য ছিল না প্রতারক চক্রের। কারণ ফিলিপিন্সের আইন অনুযায়ী ক্যাসিনোতে জুয়ায় জেতা অর্থ থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স দিলে তা বৈধ আয় বিবেচিত হয়। জুয়ায় অর্থ ব্যবহারের এটিই মূল কারণ বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। আর এখানেই ওই ক্যাসিনো দুটির জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করছেন তারা। জানা গেছে, এএমএলসি ছাড়াও ফিলিপিন্সের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এ ঘটনার তদন্ত করছে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় ক্যাসিনো দুটির ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ফিলিপিন্স অ্যামিউজমেন্ট ও গেমিং করপোরেশনও তদন্ত চালাচ্ছে, যারা ক্যাসিনোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে আরও কিছু প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলে গেলেই রহস্য আরও বেশি উন্মোচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কিছু জানাতে চাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এদিকে রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হ্যাকড হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বাড়াতে সব পিসিতে নতুন সফটওয়্যার সংযোজন করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসের সব কম্পিউটারে নতুন সফটওয়্যার সংযোজনের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটিবিষয়ক কর্মকর্তা ও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যংকের নিয়োগকৃত কনসালট্যান্ট সাইবার বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানার পরামর্শে নতুন সফটওয়্যারটি সংযোজন করা হচ্ছে বলে অফিস আদেশে বলা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য নতুন এ সফটওয়্যারটি সরবরাহও করবেন রাকেশ আস্তানা। গভর্নর ড. আতিউর রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ‘রাকেশ আস্তানার মৌখিক পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সব বিভাগ, ইউনিট ও সার্ভারে তার সরবরাহকৃত সফটওয়্যার (সিকিউরিটি প্যাচ) ইনস্টল করা হোক।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর