শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফিলিপাইনে ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা জানতেন

► খোঁজ মিলেছে ৬৪ মিলিয়ন ডলারের! ► ম্যানেজারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ► তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারআই

আলী রিয়াজ

ফিলিপাইনে ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা জানতেন

ফিলিপাইনে জুপিটার স্ট্রিটে রিজাল ব্যাংকের এই শাখা থেকে চুরি করা টাকা তোলা হয়। ইনসেটে ব্যাংক ম্যানেজার ডিগুইতো। ছবি : ইনকোয়েরার ডটনেট

বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার পুরো বিষয়টি জানত ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) শীর্ষ কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে ফিলিপাইনের ওই ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় প্রথমে টাকা আসার পর তা দুটি ক্যাসিনোতে পাঠানো হয়। ক্যাসিনো অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোস ডিগুইতো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) লরেন্স ট্যানের কাছে বিষয়টি জানান। তিনি পুরো টাকা লেনদেন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশেই জালিয়াত চক্র পুরো টাকা নিয়ে যায়। ক্যাসিনোর মাধ্যমে পরবর্তীতে এই টাকা হংকংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংস্থা ফিলিপাইন এন্টি মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারআই তদন্তে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্থাটিকে এ ঘটনার তদন্ত করতে ইতিমধ্যে নিয়োগ দিয়েছে। গতকাল মাইয়া সান্তোস ডিগুইতো জাপানে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। তবে ফিলিপাইন সরকার তাকে দেশ ছাড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। জানা গেছে, আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন-এসডব্লিউআইএফটি) বাংলাদেশ ব্যাংকের অংশে ঢুকে দীর্ঘদিন ধরে পুরো ব্যবস্থাটিকে নজরদারিতে রেখেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে জালিয়াত চক্র। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে কী পরিমাণ অর্থ চলতি হিসাবে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ছিল, সেই তথ্যও নেয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের চলতি হিসাবের অর্থ লেনদেন বা স্থানান্তর করা হতো, এসব বিষয়ও পর্যবেক্ষণ করে দীর্ঘদিন ধরে। জালিয়াত চক্র ফিলিপাইনের আরসিবিসির সংশ্লিষ্ট শাখায় গত বছরের মার্চে অ্যাকাউন্ট খোলার পর শাখা ব্যবস্থাপক ডিগুইতোর সঙ্গে মাকাতি সিটির একটি হোটেলে কয়েকবার বৈঠকও করেন। বৈঠকে তারা জানান, নতুন একটি ব্যবসা চালু করতে তারা এ অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এই ব্যাংক থেকে তারা ঋণ নেবেন। এরপর আর কোনো যোগাযোগ তারা করেনি গত ৫ ফেব্রুয়ারির আগে। এই তথ্য জানিয়ে শাখা ব্যবস্থাপক ডিগুইতো গণমাধ্যমে জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসার পর দুটি ক্যাসিনোতে ৬৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোনো ধরনের অনিয়ম দেখা না যাওয়ায় টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ডলার হওয়ায় তা এমডিকে জানানো হয়। তিনি নির্দেশ দেওয়ার পর ক্লায়েন্টকে টাকা দেওয়া হয়। ওই টাকাই পরবর্তীতে হংকংয়ে পাচার করে দেওয়া হয়। বাকি টাকা কোথায় আছে সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত উইলিয়াম গো’র সাইনে চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে বাকি টাকা। আরসিবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লরেন্স ট্যান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানানোর পর পুরো টাকা লেনদেন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে শাখা থেকে কোনো ধরনের সন্দেহজনক কিছু্ই বলা হয়। শুধু বিপুল পরিমাণ ডলার হওয়ায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি নেওয়া হয়। এরপরই টাকা লেনদেন করা হয়েছে। তিনি এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার কথাও অস্বীকার করেছেন। এদিকে গতকাল ডিগুইতো জাপানে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে আটকে দেয়। পরে সরকার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলে ফিলিপাইনের ইনকোয়ারি পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে।

টাকা চুরি তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারআই : হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ডলারের বেশি হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ফায়ারআইয়ের ম্যানডিয়েন্ট ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড় বড় সাইবার চুরির ঘটনাগুলোর বেশ কয়েকটির তদন্ত করেছে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানি ফায়ারআই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সই অর্থ লোপাটের তদন্তে ফায়ারআইকে সম্পৃক্ত করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানাই এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এক সময় বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিভাগে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যিনি বর্তমানে হ্যাক হওয়া টাকা উদ্ধারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া কনসালট্যান্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ হ্যাকাররা কীভাবে চুরি করল তা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রও সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এই তদন্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ঘটনা তদন্তে এফবিআইর সহযোগিতাও চেয়েছে। নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে তারা। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে ঢুকেই পেমেন্ট ট্রান্সফারের ক্রেডেনশিয়াল চুরি করে। এরপর ভুয়া সুইফট মেসেজের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভকে অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠানো হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানায়নি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন কাউকে চিহ্নিত করার বিষয় আমরা জানি না। এখন আমরা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি কীভাবে টাকা উদ্ধার করা যায়। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বিষয়টিতে কারা জড়িত সেটা খুঁজতে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। আমাদের সঙ্গে তাদের সমঝোতা আছে। পুরো টাকাই উদ্ধার করা যাবে।

সর্বশেষ খবর