শিরোনাম
রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

আদায় হয়নি হলমার্ক বিসমিল্লাহর টাকা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও ওই অর্থ আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার চার বছর পর এখন জামিনে তানভীরের স্ত্রী ছাড়া পেলেও জালিয়াতির মূল হোতা তানভীর ও তুষার এখনো জেলেই আছেন। অন্যদিকে প্রতারণার মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়েই পালিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিকপক্ষ। ফলে আত্মসাত্কৃত অর্থ আদায় হওয়ার আশা নেই বলেই ধারণা করছেন ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেলেঙ্কারির অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। ২০১২ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তখনকার সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর সোনালী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান বিআইডিএসের রিসার্চ ডিরেক্টর ড. জায়েদ বখত। বর্তমানে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করলেও হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে অর্থ আদায়ে ব্যাংকের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমরা হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে বন্ধকি জামানত এবং তাদের সম্পদের মর্টগেজ রাখার দিকে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আলোচনার মাধ্যমে হলমার্ক কিছু সম্পদ দিতে রাজিও হয়েছিল। তবে জেল থেকে ছাড়া না পাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের কাছে তাদের যে জামানত আছে, সেটি ৫০০-৬০০ কোটি টাকার বেশি হবে না। ফলে অর্থ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা আছেই।’ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঋণের দায় হিসেবে হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে প্রায় ৬ হাজার ১১৮ শতাংশ সম্পত্তি বন্ধক নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও প্রায় ৭ হাজার ৭ শতাংশ সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান ছিল, যার মূল্য হতে পারে ৭৫৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে বন্ধক নেওয়া এবং বন্ধকের জন্য প্রক্রিয়াধীন সম্পদের মোট মূল্য ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে জমি বন্ধক নেওয়ার এ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে জানা গেছে। ফলে অর্থ আদায়ের সম্ভাবনাও থেমে গেছে। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কারাগারে থাকায় প্রস্তাবিত ৭ হাজার ৭ শতাংশ সম্পদ বন্ধক নেওয়ার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। তবে সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ফলে প্রস্তাবিত সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী জেসমিন ও গ্রুপের জিএম তুষার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তাদের শিল্প-কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায়। সরকারকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হলমার্ক গ্রুপের যে কারখানা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ববি ফ্যাশনস লি., ওয়ালমার্ট ফ্যাশনস লি., হলমার্ক ডিজাইন ওয়্যার লি., জিসান নিট কম্পোজিট, ববি ডেনিস কম্পোজিট, হলমার্ক স্টাইল লি. ও ইসলাম ফ্যাশনস লি.। এ ছাড়া ঢাকার ধামরাইয়ের কালামপুরে আরও দুটি প্রজেক্ট রয়েছে হলমার্ক স্পিনিং মিল লি. ও ববি প্ল্যান্ট প্রিন্টিং লি. নামে। এসব শিল্প-কারখানা ও প্রজেক্টের মূল্যবান অনেক যন্ত্রাংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে শিল্প-কারখানা বিক্রি করেও আত্মসাত্কৃত অর্থ আদায় সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুদকের তদন্ত থেকে জানা যায়, হলমার্ক নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাজিয়ে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা (রূপসী বাংলা) থেকেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এ অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আরও চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বেসরকারি ২৬টি ব্যাংকের লেনদেনও পরে যুক্ত হয়। প্রায় একই কায়দায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। প্রতারণার জন্য হলমার্ক গ্রুপের দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী হলেও বিসমিল্লাহ গ্রুপের টার্গেট ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের জনতা এবং বেসরকারি প্রাইম, প্রিমিয়ার, যমুনা ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। তবে হলমার্ক গ্রুপ জালিয়াতির ঋণে দেশে কল-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও সে পথে হাঁটেনি বিসমিল্লাহ গ্রুপ। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে স্বীকৃত বিল ক্রয়, ভুয়া ঋণ সৃষ্টি ও রপ্তানি না করেও সরকারি নগদ সহায়তার সুবিধা উত্তোলনের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী নওরীন হাসিব ও পরিচালক শফিকুল আলম চৌধুরী দেশ ছেড়েই পালিয়ে যাওয়ায় এ চক্রটির হাতিয়ে নেওয়া অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর