শিরোনাম
শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

নৌকার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের এমপিরা

রফিকুল ইসলাম রনি

নৌকার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের এমপিরা

দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অধিক সংখ্যক দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নিজ দলের কিছু এমপি। এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্র্রোহী বা বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন তারা। বিগত পৌরসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের বিপক্ষে কাজ করা এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের সাংগঠনিক শাস্তি না দেওয়ায় ইউপিতেও তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতারা। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যা য়ের নেতারা বলছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের ইতিমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং মদদদাতাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জেলার রিপোর্ট দলীয় সভাপতির হাতে জমা পড়েছে। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের ইন্ধনদাতাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রথম দফায় ৭২৬ ইউপিতে ভোট গ্রহণ আগামী ২২ মার্চ। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে দলীয় প্রার্থীদের ততই ঘুম হারাম হচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থী এবং স্থানীয় এমপিদের মদদ থাকায় তারা জয় নিয়েও শঙ্কিত বলে জানা গেছে। 

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন আকন মোহাম্মাদ শহীদ। কিন্তু দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি, দিয়েছে তৃণমূলে জনপ্রিয় ও কর্মীবান্ধব গোলাম নাছিরকে। ‘নিজের লোক’ মনোনয়ন না পাওয়ায় ‘দেখে নেওয়া’র শপথ নিয়ে বিদ্রোহী দাঁড় করিয়েছেন আকন মোহাম্মাদ শহীদকে। শুধু তাই নয়, এমপিদের প্রচার-প্রচারণা চালানোর বিধিনিষেধ থাকলেও রাতের আঁধারে গাড়িতে করে তাবলিগ জামাতের লোকজন নিয়ে তিনি জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কাকচিড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলাউদ্দিন পল্টু তার অনুসারী না হওয়ায় বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেনের পক্ষে কাজ করছেন এই এমপি। রায়হানপুর ইউনিয়নে আপন ফুপাতো ভাই বিএনপি কর্মী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ এমদাদুল হক লাভলুর পক্ষে কাজ করছেন। বেতাগী উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নফিছুর রহমান চুন্নুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অপরদিকে ২নং বেতাগী ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী রাজাকার কমান্ডার বজলু ডিলারের ছেলে নজরুল ইসলামের পক্ষে ও হোসনাবাদ ইউনিয়নে আরেক রাজাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বারেক হাওলাদারের ছেলে মাকসুদুর রহমান ফোরকানের পক্ষে কাজ করছেন বরগুনা-২ আসনের আওয়ামী লীগের এই এমপি। বামনা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মধ্যে  ডৌয়াতলা ইউনিয়ন ব্যতীত বাকি তিনটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। বরগুনা সদর উপজেলার ৪নং কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরিফুর রহমান মারুফ মৃধার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল হাকিমের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান নসা। 

নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের এমপি আয়েশা ফেরদৌস হলেও লোকে মনে করে, কার্যত এখানে তার স্বামী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীই এমপি। আলীর ইচ্ছার বাইরে কোনো কাজ হওয়ার সুযোগ নেই। হাতিয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে বুড়িচর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কল্লোল চেয়ারম্যান। তিনি মোহাম্মদ আলীর অনুসারী। তাই সেখানে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। বাকি ৬টি ইউপিতে একাধিক বিদ্রোহী মাঠে রেখেছেন মোহাম্মদ আলী। শুধু বিদ্রোহীদের মাঠে রাখাই নয়, আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা করে এলাকা ছাড়া করাসহ ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে বদ্ধপরিকর তিনি। উপজেলার তমরদ্দি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ফখরুল ইসলাম। সেখানে নৌকার প্রার্থী হারাতে মাঠে বিদ্র্রোহী প্রার্থী রেখেছেন ফারুক কামাল উদ্দিন। চরঈশ্বর ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী চারবারের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আজাদ। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় যাওয়ার পথে মোহাম্মদ আলীর লোকজন তাকে গুলি করে। সোনাদিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল ইসলাম। এখানে বিদ্রোহী ইয়াসিন আরাফাতকে ভোট দিতে প্রভাব বিস্তার করছেন মোহাম্মদ আলী। নিঝুমদ্বীপ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেহেরাজ উদ্দিন। অভিযোগ রয়েছে, এই ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারাতে দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির প্রার্থীকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, হাতিয়াতে মোহাম্মদ আলীই স্বঘোষিত এমপি। তার কথায় সব হয়। তার পছন্দের প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় নৌকার বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেছেন। দলীয় চেয়ারম্যান প্রাথীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা করে এলাকাছাড়া ও ভোটারদের নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন।

বাগেরহাটের শরণখোলায় ধানসাগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মইনুল ইসলাম টিপুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় এমপি ডা. মোজাম্মেল হক। একই অবস্থা খোন্তাকাটা ইউনিয়নেও। সেখানেও দলীয় প্রার্থী মহিউদ্দিন জাকিরের বিরুদ্ধে তার অনুসারীদের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া মীর শওকত আলী বাদশার বিরুদ্ধেও সদরের ৬টি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীদের গোপন সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের ভাষানচর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম চুন্নু। সেখানে স্থানীয় এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বিদ্র্রোহী প্রার্থী মজিবর রহমানের পক্ষে কাজ করছেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থী নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আমার লোকজনকে মারধর ও নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে এমপির অনুসারীরা। পুলিশকে মাঠে নামানো হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। চরগোপালপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল জলিল। বিদ্রোহী প্রার্থী সঞ্জয়কে সমর্থন দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি পঙ্কজ দেবনাথ। ভাষানচরেও বিদ্রোহী প্রার্থীকে মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া খুলনায় সরকারদলীয় এমপি নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ইউপিতে বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আউয়াল এমপি। তিনটি উপজেলা নিয়ে তার নির্বাচনী এলাকা। তার পছন্দের প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় প্রায় প্রত্যেকটি ইউপিতে একজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন প্রভাবশালী এ এমপি। মূলত তিনি নিজের আধিপত্য ও প্রভাব ধরে রাখতে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যেখানেই তার ‘পছন্দের মানুষ’ দলীয় মনোনয়ন পাননি, সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। গুয়ারেখায় হীরালাল বড়ালের পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন সুব্রত কুমার ঠাকুর। সারেংকাঠিতে সায়েম শেখের পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন নজরুল ইসলাম। আর শুটিয়াকাঠিতে রুহুল আমিনের পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন গাউছ মিয়া। কিন্তু তিনটি ইউনিয়নেই দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন করছেন স্থানীয় এমপি আউয়াল। 

সর্বশেষ খবর