বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভোটে গুলি বর্জন দখল

ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত ১০, আহত সহস্রাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোটে গুলি বর্জন দখল

বাঞ্ছারামপুরে পূর্বহাটি প্রাথমিক স্কুল কেন্দ্রে নারী ভোটারদের সারি। পিরোজপুরে নিহতের পাশে বাবার আহাজারি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, বর্জন আর গোলাগুলির মধ্য দিয়ে গতকাল সারা দেশে সম্পন্ন হয়েছে প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলে। গতকাল নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১০ জন। রাত ৮টার দিকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিসাফা ইউনিয়নে গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। একই সময় টেকনাফে মারা গেছেন দুজন এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে একজন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিরাজগঞ্জের রায়পুরে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর সংঘর্ষে মারা যান ৪৫ বছর বয়সী এক মহিলা। এ ছাড়া ঝালকাঠিতে নিহত হয়েছেন একজন। এর মধ্যে ভোট গণনাকালেই মারা গেছেন নয়জন। সংঘাত-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত অর্ধশত। এর আগে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে ভোট গণনাকালে এতসংখ্যক প্রাণহাণির ঘটনা ঘটেনি। প্রথম ধাপে সংঘাত-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সর্বমোট ১৯ জন মারা গেছেন।

গতকাল ইউপি ভোটে ভোটকেন্দ্রে নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। জাল ভোটের প্রভাবও ছিল বেশ কিছু এলাকায়। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে বের করে দিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনাও ঘটেছে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগে বেশি সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। সাময়িকভাবে কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ হলেও স্থগিতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, অনিয়ম ও সংঘর্ষের ঘটনায় ৬৫ কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করা হয়। প্রথম ধাপে ৫৪টিতে সরকারদলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ইউপি নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় ২০ জন নিহত হয়েছেন। প্রার্থী, সমর্থকসহ আহত হয়েছেন সর্বমোট তিন হাজার। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় ৬০০। তবে কোনো অভিযোগের প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা। নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২০ জন করে সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), র‌্যাব, বিজিবি, আনসারের সমন্বয়ে গড়া ভ্রাম্যমাণ ও অপেক্ষমাণ বাহিনী (স্ট্রাইকিং ফোর্স) এবং বিচারিক ও নির্বাহী হাকিমরা মাঠে ছিলেন। দিনভর ব্যস্ত ছিল নির্বাচন কমিশন। বিভিন্ন স্থানে অনিয়মের অভিযোগে রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা পাঠালেও খুব একটা কাজে আসেনি। গতকাল নানা অভিযোগ নিয়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনে যান।

পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিসাফা ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। নিহত পাঁচজন হলেন—সোহেল, শাহাদাত, কামরুল, সোলায়মান ও বেলাল। ঘটনাস্থলেই সোহেল, শাহাদাত ও কামরুল মারা যান। বাকিরা মারা যান বরিশাল মেডিকেলে নেওয়ার পথে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিসাফা ইউনিয়নের সাফা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে ফলাফল গণনার সময় নৌকা মার্কার প্রার্থী হারুন অর রশিদ ও স্বতন্ত্র রফিকুল ইসলামের প্রাপ্ত ভোট নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে ফলাফল ঘোষণা না করে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন্দ্র থেকে জেলা শহরের দিকে রওনা হলে নৌকার সমর্থক ও স্থানীয়দের একটি অংশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে তারা প্রশাসনের গাড়ি ঘিরে ফেলে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবরুদ্ধ করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়লে স্থানীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরই একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে তিনজন ও বরিশাল নেওয়ার পথে দুজন মারা যান। নিহত সবাই আওয়ামী লীগের কর্মী। পিরোজপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু আশ্রাফ জানান, ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা চলছিল। গণনার  শেষ পর্যায়ে ফল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে যেতে থাকলে তার সমর্থকরা কেন্দ্রটি অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় পুলিশ তাদের সরে যেতে বললেও তারা সরেননি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি ছুড়লে তিনজন ঘটনাস্থলেই এবং আরও দুজন বরিশাল নেওয়ার পথে মারা যান। মঠবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিউদ্দিন আহমেদ ফেরদাউসও একই তথ্য দিয়ছেন।

টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে গতকাল টেকনাফের সাতরাং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী নূর হোসেনের ভাই আবদুল গফুর গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে শফিক নামে ২৪ বছরের এক যুবকও গুলিবিদ্ধ হন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনিও মারা যান। দুটো ঘটনাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর।

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, সৃষ্ট নির্বাচনী সহিংসতায় গতকাল রাতে নেত্রকোনার হাওরদ্বীপ খালিয়াজুড়িতে যুবলীগ কর্মী গোলাম আবু কাউছার (৩২) নামে একজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তি আওয়ামী লীগ মনোনীত খালিয়াজুড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম আবু ইছহাকের ছোট ভাই। গতকাল উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নেই ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। ভোট গ্রহণ শেষ হলে খালিয়াজুড়ি ইউনিয়নের আদাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে সৃষ্ট নির্বাচনী সহিংসতায় গোলাম আবু কাউছার (৩২) গুলিবিদ্ধ হন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় খালিয়াজুড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সুধীর চন্দ্র দাস মৃত ঘোষণা করেন। কে বা কারা গুলি করেছে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছুই জানা যায়নি। তবে কাওছারের ভাই জানান, রাত ৭টার দিকে আদাউড়া কেন্দ্রে ভোট গণনা ও ফলাফল নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, বেলা আড়াইটায় সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নে কালি আন্দার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী চুন্নু সিকদার ও সজীব হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২০-২৫ জন আহত হন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত চুন্নু সিকদারের বড় ভাই আবুল কাশেম সিকদারকে (৬৫) ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে বিকাল ৪টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১০টায় গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আমিনুল ইসলাম লিটনের ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম প্রিন্সসহ দুজনকে কুপিয়ে আহত করেন প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী, জেলা  সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রাশাসক সরদার মো. শাহ আলমের ভাগ্নে মাসুম শেরওয়ানীর সমর্থকরা। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে বরিশাল বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করেন। নির্বাচনের আগের মধ্যরাতে আমিনুল ইসলাম লিটনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রায়গঞ্জে ইউপি নির্বাচনে ইউপি সদস্য পদে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নওনাই বেগম (৪৫) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নের জয়ানপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত নয়না বেগম ওই গ্রামের ইনছাব আলীর স্ত্রী ও বিজয়ী প্রার্থী নবাব আলীর ছোট ভাইয়ের শাশুড়ি। রায়গঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক কঙ্কণ বিশ্বাস জানান, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিজয়ী মেম্বার প্রার্থী বিএনপি সমর্থিত নবাব আলী ও পরাজিত প্রার্থী সামিদুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষ চলাকালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় সামিদুলের লোকজনের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে নওনাই বেগম ঘটনাস্থলেই মারা যান। এতে উভয় পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের কড়াপুর পপুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে হানা দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাবিবুর রহমান খোকনের একদল কর্মী-সমর্থক। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বিএম কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম আসাদুজ্জামান জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে একদল দুষ্কৃতকারী অকস্মাৎ কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট ও বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় দায়িত্বরত পোলিং অফিসারদের সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তি হয়। এতে বেশ কিছু ব্যালট ও নির্বাচনী সরঞ্জাম নষ্ট হয়। এ সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা ৩০০ ব্যালট পেপার এবং একটি বাক্স ছিনতাই করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটলেও তারা ছিল নির্বিকার। ছিনতাই হওয়া ব্যালট কিংবা বাক্স উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনার পর প্রিসাইডিং অফিসার ভোট গ্রহণ স্থগিত করেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্য কর্মকর্তারা নির্বাচনী সরঞ্জামসহ পুলিশের প্রহরায় কেন্দ্র ত্যাগ করেন। একই ইউনিয়নের মঙ্গলহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা সংঘর্ষ ও ব্যালট ছিনতাইয়ের চেষ্টার করলে বেলা ১১টায় ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া ওই ইউনিয়নের বারুখায়ের দিঘিরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কটুরাকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই পক্ষের সংঘর্ষের কারণে ভোট গ্রহণ সাময়িক স্থগিত ছিল। সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের পশ্চিম ভেদুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে ক্ষমতাসীদের জাল ভোট দিতে বাধা দেওয়ায় ছাত্রদল নেতা আবদুল কাদেরকে পিটিয়ে জখম করা হয়।

নিজের অস্ত্রে নিহত : বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের মুরারবাড়ী কেন্দ্রে দায়িত্বরত আনসার সদস্য আল আমিন (৪০) নিজ অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গতকাল সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আল-আমিন একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে মুরারবাড়ী কেন্দ্রের সামনে চেয়ারে বসে অন্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অসাবধানতাবশত রাইফেলের ট্রিগারে তার হাতের চাপ পড়ে গেলে বিকট শব্দে একটি গুলি বের হয়। গুলিটি তার ডান হাতের কনুই বরাবর ভেদ করে বাঁ হাতের কুনই বরাবর বিশাল মাংসপিণ্ড নিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন আল আমিন। তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ভোলা প্রতিনিধি জানান, ভোলায় ভোট গ্রহণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ১০ চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং পাঁচ ইউপি সদস্য প্রার্থী ভোট বর্জন করেন। পুলিশ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ১০ জনকে আটক করেছে। সদর উপজেলার বাপ্তা, দক্ষিণ দিঘলদী, পশ্চিম ইলিশা, ধনিয়া ও শিবপুর; বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া, কুতুবা; দৌলতখানের চরখলিফা, জয়নগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে মেম্বার প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ধনিয়া ইউনিয়নে পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে আহত হয়েছেন কহিনুর ও তার মেয়ে মাহিনুর আব্বাস। এ ছাড়া কুতুবায় সালাউদ্দিন, মনির, আবু কালাম ও ফাতেমা এবং বাপ্তা ইউনিয়নে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন হানিফ নামের এক ব্যক্তি। এদিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত বাপ্তার ইউসুফ ও টবগি ইউনিয়নের সুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বরগুনা প্রতিনিধি জানান, জেলার ৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মীদের কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্ট ও কর্মীদের ওপর নির্যাতন এবং ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সহজেই ভোট কারচুপির মহোৎসব চালান। প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ও অসহযোগিতার প্রতিবাদে বরগুনা ও পাথরঘাটায় ১২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বেলা ১২টায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বেতাগীর দক্ষিণ ভোলানাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে নৌকার সমর্থকরা প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, জেলায় ভোট গ্রহণকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছে জামায়াত সমর্থকদেরও। এ ছাড়া সারা দিন টুকেরবাজার ও টুলটিকর ইউনিয়নে কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বেলা সোয়া ১২টার দিকে যুবলীগ নেতা দুলাল আহমদ ও শাহেদ আহমদের নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা টুকেরবাজার ইউনিয়নের আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালায়। এ সময় তারা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় ও বিএনপির প্রার্থী শহীদ আহমদের পোলিং বুথ ভাঙচুর করে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ চলাকালে ভোট গ্রহণ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। ভোট গ্রহণ পুনরায় শুরু হলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে ঢুকে জোর করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলতাফ হোসেনের নৌকা প্রতীকে সিল মারা শুরু করে। সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কেন্দ্রে আসার সময় অদূরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা পোলিং অফিসার সাহাদাত হোসেন ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আবদুল আউয়ালকে পেছন দিক থেকে গুলি করে। গুরুতর অবস্থায় তাদের হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে হাতিয়ায় কেন্দ্রে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। চরজব্বার ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী মো. আবদুল্লাহ কেন্দ্র দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নে সাতবিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা সোয়া ১১টায় জাল ভোট দেওয়া নিয়ে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা ভোট গ্রহণ স্থগিত ছিল। একই ইউনিয়নের হোসেনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়। তেজখালী ইউনিয়নের হাসননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে তিনজন টেঁটাবিদ্ধসহ পাঁচজন আহত হন। বাঞ্ছারামপুরে কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপির ছয় চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে রামগতি ও কমলনগরের ছয় ইউপির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সংঘর্ষে ছাত্রলীগ নেতাসহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হন। জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগে পাঁচ নারী ভোটারসহ সাতজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বেলা ৩টা। রায়গঞ্জের ধানগড়া ইউপির জয়ানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২ নম্বর বুথে দেখা যায় ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পদের ব্যালট ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, চেয়ারম্যান পদের ব্যালট পেপার দুর্বৃত্তরা নিয়ে নৌকা মার্কার সিল মাইরা বাক্স ভরছে। কারা নিয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না। তবে প্রিসাইডিং অফিসার জানেন।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি জিন্নাহ আলমাজি ও তার ছেলে হাসানের নেতৃত্বে ব্রহ্মগাছা ইউপির জানকীগাঁতী-বারইভাগ কেন্দ্রে ভোটারদের কাছ থেকে ব্যালট কেড়ে নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর সকাল সাড়ে ৯টায় হাটশেরপুর তাজুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং বেলা ১১টায় সদর ইউনিয়নের পারতিতপরলে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মঝে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া জোড়গাছা ইউনিয়নে একই ঘটনা ঘটেছে।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গি ইউনিয়নের বলাবাড়িয়া এলাকায় ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়ায় হুমায়ুন কবির নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে জখম করেছে জনতা। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে সকাল ১০টার দিকে সাবদালপুর ইউনিয়নের বহিরগাছি গ্রামে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষে আটজন আহত হয়েছেন।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, মিরপুর উপজেলায় ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ এনে চারটি ইউনিয়নে পুনরায় নির্বাচন দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। বেলা ১১টায় ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুস সালাম দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকজন সমর্থককে দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মেরে নেন। সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে আবদুস সালামের ক্যাডার বাধা দেয়। ফুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, বেলা ২টার মধ্যেই ১০০ ভাগ ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।

দোহার (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার কুসুমহাটি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চরকোসাই ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার এরশাদ হোসেন ব্যালট পেপারে সিল মারার পর হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। ধরা পড়ার পর ৫০-৬০টি ব্যালটে জাল ভোট দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। এ ঘটনার পর ওই কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দুজন আহত হয়েছেন। নৌকা প্রতীকে সিল মারা ব্যালট পাওয়া যায় তার টেবিলের নিচে।

পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, মঠবাড়িয়ার মিরুখালী ইউনিয়নের বাদুরা কেন্দ্রে গিয়ে আগে থেকেই ব্যালট পেপারে নৌকা মার্কায় সিল মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যালট পেপার প্রকাশ্যে বাক্সে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন ভোটাররা। দাউদখালী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মীদের হামলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহিদুল আলম শামীম আহত হয়েছেন। স্বরূপকাঠিতে ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন নৌকা মার্কার একজনসহ বিএনপির তিন চেয়ারম্যান প্রার্থী। জেলার কাউখালীতে ব্যালট বাক্স ও পেপার ছিনতাই করার সময় আহত হয়েছেন এক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। এ ছাড়া মঠবাড়িয়া বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে আহত হন একজন। এদিকে চিড়াপাড়া ইউনিয়নের বড় বেকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকার সমর্থকরা সাতটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের মারধর, কেন্দ্র দখল, ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল মারা, জাল ভোট, ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাই, ভাঙচুর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, দুই শতাধিক রাউন্ড ফাঁকা গুলি, লাঠিচার্জ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত ও অবরুদ্ধ রাখার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।

নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়নে ব্যালট পেপারে সিল মারা, কেন্দ্র থেকে সমর্থকদের বের করে দেওয়ার অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ইকবাল।

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, ভোট কারচুপি ও এজেন্টদের জোর করে কেন্দ্র দখলের অভিযোগে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাঁশকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আক্কাস মোল্লা ভোট বর্জন করেছেন। মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট ডাকাতি আর সহিংসতার অভিযোগ এনে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের ১০টি ইউনিয়নের চার ইউপির বিএনপি প্রার্থীরা বেলা ৩টার দিকে নির্বাচন বর্জন করেছেন। বর্জনকারী প্রার্থীরা হলেন রসুনিয়া ইউনিয়নের আবদুল খালেক শিকদার, মধ্যপাড়া ইউনিয়নের আজিম আল্রাজি, বালুচর ইউনিয়নের আমিন উদ্দিন চৌধুরী ও মালখানগর ইউনিয়নের মো. আজিজুল হক।

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, ফুলপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ভোট চলাকালে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ফুলপুরের পয়ারি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল কবিরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ওই কেন্দ্রে ১৫ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। পুলিশ সংঘর্ষ ঠেকাতে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর