শিরোনাম
সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

নৈতিকভাবে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন তারা

জুলকার নাইন

আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মন্ত্রিত্বে থাকা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা তা দেখার অপেক্ষায় আছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের আইন বা সংবিধানে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হলে মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নৈতিকভাবে দুই মন্ত্রী পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন। তাদের নেওয়া শপথ রক্ষার খাতিরে দ্রুত পদত্যাগ করা উচিত। সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শপথ ভঙ্গের বিষয়টিকে উল্লেখ করে সংবিধানের ১০২ নম্বর ধারার অধীনে নতুন করে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে আইনিভাবেও তাদের মন্ত্রিত্ব রক্ষা কঠিন হতে পারে। এ ধারায় অস্পষ্ট যে কোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিকের সর্বোচ্চ আদালত থেকে আইনি নির্দেশনা পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ এর ঘ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যুন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে। এবং ৬৬ (২) ঙ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না যদি তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া থাকেন। সংবিধানের এই দুই ধারার কথা উল্লেখ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাজা পেলেও সংবিধান অনুসারে মন্ত্রিত্ব হারাবেন না কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক। আবার আমাদের সংবিধানে রিভিউয়ের একটা পদ্ধতির কথা বলা আছে। মন্ত্রীরা যদি তেমন উপদেশ পান তাহলে রিভিউয়ের একটি বিধান কার্যকর করার বিষয়ে তারা চেষ্টা করতে পারেন। আর নৈতিকতার সিদ্ধান্তের বিষয়টি মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত এবং মন্ত্রিসভার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে কিছু বলার থাকতে পারে না।’ এ ধরনের ঘটনায় মন্ত্রিত্ব থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই উল্লেখ করে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘মন্ত্রীর বিষয়ে বলা আছে যে, প্রধানমন্ত্রী যতজন প্রয়োজন মনে করবেন ততজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন তাহলে কোনো মন্ত্রীকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের মন্ত্রিপরিষদে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্তরাও কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে আছেন। তারা আপিল করেছেন ওই অজুহাতে, এটাও খুব দুর্ভাগ্যজনক। এটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়, সুতরাং আপিলের কোনো সুযোগ নেই, এটাই চূড়ান্ত রায়।’ তবে এবারের ঘটনায় মন্ত্রী হিসেবে তাদের পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত থেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। প্রতি সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক হয়। সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত অপরাধী কীভাবে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে বসবেন? দেশের মানুষ জেনে গেছেন, তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। দোষী সাব্যস্ত হয়ে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করলে মানুষ কী বলবে? সুতরাং আমার প্রত্যাশা হবে, মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই  কোনো একসময় তারা পদত্যাগ করবেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত দুই মন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন বলেও আদালত মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে দায়িত্বরত দুই মন্ত্রীকে আদালত শাস্তি দিলেন। শাস্তির মাত্রা যাই হোক, শাস্তি মানেই হলো তাদের দোষ প্রমাণিত। এরপরে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মন্ত্রী থাকার কোনো কারণ নেই। এখন নৈতিক অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীরও তাদের পদত্যাগ করতে বলা প্রয়োজন, তাদের নিজেদেরও উচিত পদত্যাগ করা। তবে আইনগত দিক থেকে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে, আদালত অবমাননার কারণে শাস্তি হলে মন্ত্রিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় না। তবে উচ্চ আদালত যেহেতু দুই মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ করার কথা বলেছেন, সেহেতু কেউ যদি এখন উচ্চ আদালতে তাদের মন্ত্রিত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে যে কোনো কিছুই সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে যে কেউ এখন চ্যালেঞ্জ করে আদালতের কাছে জানতে চাইতেই পারেন। তখন এই দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব আইনগতভাবেও জটিলতার মুখে পড়তে পারে।’ আসিফ নজরুল আরও বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এই রায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কারণ এর আগে মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে কোনো ধরনের মন্তব্য করে এসেছেন। তখন উচ্চ আদালত তাদের কিছু বলেননি। উচ্চ আদালত যদি শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের কিছু না বলেন, তখন অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ কমে আসে। এবারের এই রায় সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটালো।’

সর্বশেষ খবর