বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফিলিপাইনে অপরাধী শনাক্ত বাংলাদেশে খবর নেই

মানিক মুনতাসির

ফিলিপাইনে অপরাধী শনাক্ত বাংলাদেশে খবর নেই

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনে মাফিয়া চক্রকে মোটামুটি চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কেউই এখনো শনাক্ত হয়নি। সিআইডি, এফবিআই ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত কার্যক্রম চালালেও তারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই।

ফিলিপাইনে অভিযুক্ত ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম ওং সর্বশেষ গতকাল দুই চীনা ব্যবসায়ীর নাম বলেছেন, যারা এ ঘটনায় জড়িত বলে তিনি দাবি করেছেন। সেইসঙ্গে কিম ওং তার কাছে থাকা ৪৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ফেরত দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর এখন দায় এড়াচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষও। তারা নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার না করলেও ব্যাংক কর্মকর্তা-হ্যাকার, সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী ছাড়াও তৃতীয় আর কেউ সংশ্লিষ্ট কিনা তার খোঁজে নেমেছে ফিলিপাইন। এক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সূত্র জানায়, ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ করছে না ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তারা নিজেরা জবাব না দিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে উত্তর দিচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ মেইলে সাড়া দিচ্ছে দুই-তিন দিন পর পর। বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফার্মেশন না পেয়েই ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ পাঁচটি পেমেন্ট আদেশ সম্পন্ন করেছিল। অথচ একই সময়ে আরও ৩০টি পেমেন্ট আদেশ বন্ধ করে দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, ওই পাঁচটি পেমেন্ট তারা কেন দিল। কিংবা ৩০টি পেমেন্ট কেনইবা বন্ধ করল। সেখানে যে কোম্পানির নামের বানান ভুলের কথা বলা হচ্ছে, সেটাও বানানো কিনা—এ নিয়ে নানা প্রশ্ন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা বলছেন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের আচরণ প্রথম থেকেই রহস্যজনক। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার ও সুইফট কোড হ্যাকিংয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের যোগসাজশ রয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখেছে ফিলিপাইন। কেননা দেশটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো (চাকরিচ্যুত) একজন ব্যবসায়ীর নামে হিসাব খুলে অর্থ স্থানান্তরে সহায়তা করেছেন। যদিও ওই ব্যবসায়ী তা অস্বীকার করেছেন এবং দেগুইতোর বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দিয়েছেন। এর সঙ্গে ওই ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো চক্রের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে মনে করে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত আরেক সংস্থা অ্যাগমন্ট গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংক, এএমএলসি, অ্যাগমন্ট গ্রুপ, এফবিআইসহ তদন্তকারী বেশিরভাগই সংস্থাই মনে করে, তাদের কাছে যে ধরনের তথ্য-প্রমাণ এসেছে, তাতে ব্যবসায়ী উইলাম গো’র কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা আছে। কারণ রিজাল ব্যাংকে তার নামে হিসাব খোলা হয় এবং সেই হিসাবের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। এমনকি তার কোনো নিকট আত্মীয় এ কাজ করতে পারে বলেও ধারণা তদন্ত সংস্থাগুলোর। ফলে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী, তিনি কোনোভাবে দায় এড়াতে পারেন না। ফিলিপাইনে সিনেট কমিটির শুনানিতে গতকাল ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম ওং এবং রিজাল ব্যাংকের কর্মকর্তা অ্যাঞ্জেলা তোরেসকে হাজির করা হয়। কিম এ সময় বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দুই চীনা ব্যবসায়ী জড়িত। তারা হলেন সুহুয়া গাও এবং ডিং ঝিজে। রিজেল ব্যাংকের মাধ্যমে তারা ওই অর্থ ফিলিপাইনে নিয়ে আসেন।’ তবে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে কিম ওং তার সোলেয়া ক্যাসিনো রিসোর্টস হোটেলের হিসাবে থাকা ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দেবেন বলে জানান। সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফাইনাল পেমেন্ট অর্ডার যাওয়ার আগেই লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। সেটা কেন হলো। এতে রিজাল ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবহেলা বা অন্য কোনো ইন্টারেস্ট ছিল কিনা। অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কেউ সংশ্লিষ্ট কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এএমএলসি, অ্যাগমন্ট গ্রুপসহ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং সংস্থাগুলো নড়েচড়ে বসায় খোয়া যাওয়া অর্থ ফেরতের সম্ভাবনা বাড়ছে।

দেশের কেউ জড়িত কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বাংলাদেশের কেউ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ ও মানববন্ধনে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ কথা বলেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, রিজার্ভের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। দুদক তদন্তগুলোর ফলাফল যাচাই করে নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে। এ ছাড়া নিজস্ব পদ্ধতিতে কমিশনের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে পারলে সমাজ থেকে দুর্নীতি কমবে। এর আগে দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের অংশ হিসেবে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে এক শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রাটি জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও কমাতে সব পদক্ষেপ নিতে কর্মসূচি নিয়েছি। আশা করি, জনগণ ও দেশ দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।

সুনাম রক্ষায় টাকা দেবে রিজার্ভ ব্যাংক : বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি বলেছেন, ‘রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি যাওয়া অর্থ ফিরে পেতে মামলা করার প্রয়োজন নেই। নিজেদের সুনামের ঝুঁকি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন অর্থ ফেরত দেবে বলে আমার বিশ্বাস।’ তিনি বলেন, ‘তারা লজ্জায় এমনি টাকা দিয়ে দেবে। আমার তো মনে হয়, এখনই দিয়ে দেওয়া উচিত। মামলা করার প্রয়োজন নেই। তাদের একটা বিরাট রেপুটেশন রিস্ক আছে।’ অর্থ লোপাটের বিষয়ে গতকাল সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিতে নিজ চেম্বারে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি। ২৩ মার্চ রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের ঘটনা খতিয়ে দেখতে ব্যারিস্টার কিউসিকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেন, ‘মামলা তো করাই যায়। আমি তো চুরির একটা ভিকটিম। যে টাকা দিয়েছে, সেটি তো আমার ইনস্ট্রাকশন অনুসারে দেওয়ার কথা। সেটি তো আমি (বাংলাদেশ ব্যাংক) দিইনি। এটি ক্লিয়ার। ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে চোর। চোরের ইনস্ট্রাকশন অনুসারে কাজ করলে আমরা তো বলতেই পারি, তুমি আমার ইনস্ট্রাকশন অনুসারে কাজ করনি। আমার টাকা ফেরত দাও। এটি সহজ একটি ব্যাপার।’

ব্যারিস্টার কিউসি বলেন, সবাই (বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক) যদি মনে করে, রিজার্ভ ব্যাংক নিরাপদ নয়, তাহলে তাদের টাকা নিয়ে যাবে। আর তাই রিজার্ভ ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে না। কীভাবে টাকা উদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা উদ্ধার করার জন্য আমরা যেটি দেখছি সেটি হলো, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি আছে। যেটি নিউইয়র্কে আছে সেটি সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলোর ব্যাংক। এখানে ২৫০টি সেন্ট্রাল ব্যাংকের শাখা আছে। সেখানে আমাদের টাকা রাখার উদ্দেশ্য হলো, টাকাটা যাতে নিরাপদ থাকে। ওটি একটি নিরাপদ জায়গা। নিরাপদ হলেও দেখা যাচ্ছে, আমাদের টাকা সেখান থেকে চলে গেছে। অন্য জায়গায় গেছে। আমরা পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন দিইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন দেয়নি। তা সত্ত্বেও চলে গেছে।’ তিনি বলেন, তারা কি বুঝতে পারেননি যে ফেইকভাবে টাকা চলে গেছে! সে জন্য তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন কি না, সেটি আমি দেখছি। আরেকটি জিনিস দেখছি যে, সিস্টেমের মধ্যে কোনো ক্ষত আছে কি না। সিস্টেম ডিফিসিয়েন্সি আছে কি না। তো দেখা যাচ্ছে, কিছু সিস্টেমে ডিফিসিয়েন্সি আছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক যে ইনস্ট্রাকশনগুলোর ওপর কাজ করেছে, সেগুলোর কয়েকটির ক্ষেত্রে মনে করেছে যে জেনুইন না। সেখানে কনফারমেশন চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কনফারমেশন পাওয়ার আগে তারা পেমেন্ট করল। তিনি বলেন, আরেকটি জিনিস আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বেআইনিভাবে যদি কোনো টাকা চলে যায়, সেখানে একটি সিস্টেম আছে যে টাকাটা রিকল করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক কমপ্লেইন করেছে, ই-মেইল করেছে, চিঠি দিয়েছে। সুইফট মেসেজ দিয়েছে। সেগুলোর কোনো উত্তর আসেনি। সব তথ্য পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর