বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিমানে জামাল যুগের অবসান

নতুন চেয়ারম্যান ইনামুল বারী

লাকমিনা জেসমিন সোমা

অবশেষে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডে শেষ হলো সমালোচিত চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন আহমেদের যুগ। তার জায়গায় নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল মো. ইনামুল বারী। গতকাল এক আনুষ্ঠানিক প্রেস বার্তায় চলতি বছরের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। প্রভাব খাটিয়ে টানা সাত বছর ধরে চেয়ারম্যানের পদ দখল করে ছিলেন জামাল উদ্দিন। তার সময়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডানা ভেঙে পড়ে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির। প্রথমবার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে তা না বাড়ানোর সুপারিশ করা হলেও জামাল উদ্দিনকে সরাতে পারেনি কেউ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে বারবার চেয়ারম্যান পদে বহাল থেকেছেন এই বিতর্কিত চেয়ারম্যান। সদ্য বিদায়ী এই চেয়ারম্যানের আমলে প্রতিবছরই কয়েকশ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয় বিমানকে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রুটে একবারও লাভের মুখ দেখেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্টো বিমানকে কঠিন দেনার ভারে রেখে যাচ্ছেন জামাল উদ্দিন। বিমানের ওঠানামা, পার্কিং, বোর্ডিং, নিরাপত্তা, আকাশপথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন সার্ভিস বাবদ এখনো প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পাবে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এ ছাড়া পদ্মা অয়েল লিমিটেডসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিমানের কাছে বড় অঙ্কের টাকা পাবে। বাংলাদেশ বিমানের সেবা নিয়ে আগাগোড়াই অসন্তুষ্ট ছিলেন যাত্রীরা। শিডিউল বিপর্যয় যেন নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে যাত্রীদের। তার সময়ে বিভাগে পিয়ন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন সময় বিমানের অভ্যন্তরে হওয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও দায়িত্বশীল কিছু সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রীসেবায় নিম্নমান, অব্যবস্থাপনা, অযাচিত খরচ, কর্মকর্তাদের টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ও লুটপাট, ত্রুটিপূর্ণ পুরনো উড়োজাহাজ, অদক্ষ জনবল কাঠামো এবং সর্বোপরি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণেই এ দৈন্যদশায় পড়ে বিমান। এ খাতে গত অর্থবছরও ২৫০ কোটি টাকার ওপরে লোকসান হয় সরকারের।

সাত বছর ধরে বাংলাদেশ বিমানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেছেন জামাল উদ্দিন আহমেদ। গত বছরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, বিমানের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে তিনি উড়োজাহাজ ও এর যন্ত্রাংশ ক্রয়ে টেন্ডারবাজি এবং বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ-বাণিজ্য চালিয়েছেন সমান তালে। এমনকি এসব কর্মকর্তার গ্যাঁড়াকলে পড়ে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিটিশ নাগরিক কেভিন জন স্টিল। এরপর আরেক বিদেশি নাগরিক কাইল হেউড তার স্থলাভিষিক্ত হলেও তিনিও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি। আর সে কারণেই সম্প্রতি হেউডের মেয়াদ শেষে তাকে পুনরায় বহাল থাকার প্রস্তাব করা হলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তা নাকচ করে দেন তিনি।

কেবল নিজ প্রতিষ্ঠানেই নয়, বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়ার পর গত সাত বছরে জামাল উদ্দিন আহমেদ তিনজন বিমানমন্ত্রীর সঙ্গেই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। এর মধ্যে সবার আগে বিরোধের সৃষ্টি হয় মহাজোট সরকারের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে। এরপর সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের সঙ্গে। এরপর ২০১৪ সালে নতুন সরকার গঠিত হলে রাশেদ খান মেনন বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। শুরুতে ভালো চললেও একসময় বিভিন্ন ইস্যুতে রাশেদ খান মেনন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের ওপর বিরক্ত হন। জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে সংসদেও জ্বালাময়ী ভাষণ দেন তিনি। মূলত এর পর থেকেই মেনন প্রকাশ্যে জানান দিতে থাকেন, জামাল উদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান বহাল রাখা হলে তাকে যেন বিমান মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন পরিচালনা পর্ষদ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, নতুন বোর্ড বিমানের জন্য এক রাঙা প্রভাত নিয়ে আসবে। বিমান বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিমান হবে বাংলাদেশের মেঘদূত।

নতুন পরিচালনা পর্ষদ-২০১৬তে যারা থাকছেন : বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, পরিচালনা পর্ষদে পদাধিকার বলে থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন সচিব এবং সাবেক সচিব (পিআরএল ভোগরত), বিমান বাহিনীর সহকারী প্রধান (অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং), সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল ভোগরত) এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইমার্জিং রিসোর্সেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর-ই-খোদা আবদুল মবিন এফসিএ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর