ওষুধশিল্প সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্নের স্বর্ণদুয়ার খুলে দিয়েছে। ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারা রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ শিল্প।
এ খাতের প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। একসময়ের আমদানিকারক দেশ, এখন ওষুধের রপ্তানিকারক দেশের গৌরবে গৌরবান্বিত। এ দেশের উৎপাদিত ওষুধ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণসহ বিশ্বের ১০৯টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। পৃথিবীর এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) বা অনুন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের ওষুধের কাঁচামালের ৩০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে স্থানীয়ভাবে, বাকি প্রায় ৭০ শতাংশ আসছে বিদেশ থেকে। দেশেই ওষুধের কাঁচামাল উত্পাদন করতে পারলে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার) ওষুধ রপ্তানি করা সম্ভব। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানান, দেশে ২৫৭টি নিবন্ধনকৃত কোম্পানির মধ্যে ১৯৪টি ওষুধ উৎপাদন করছে। তবে শীর্ষস্থানীয় ১০টি কোম্পানি মোট ওষুধের ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে। ওষুধ অধিদফতরের তথ্যানুসারে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ও উপাদান এনে এখানে তৈরি বা বাজারজাতকৃত সরকার অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা ১ হাজার ২০০টি। প্রায় ২৫ হাজার ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করে এসব ওষুধ প্রস্তুত করছে প্রায় ৯০০ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ওষুধের সংখ্যা ২০ হাজার ৫০০। এ ছাড়াও বর্তমানে ২৬৮টি ইউনানি, ২০১টি আয়ুর্বেদীয়, ৯টি হারবাল, ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো প্রতি বছর আনুমানিক ২০০ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করছে। মানুষের ওষুধের পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রের ওষুধ তৈরিতেও অনুরূপ সক্ষমতা অর্জন করেছে এ সেক্টর।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ও দেশের বাজারে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে স্থানীয় বাজারে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার, যা ২০০৪ সালে ছিল ২ হাজার ৮৭৩ কোটি এবং ২০০৩ সালে ২ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে মানসম্পন্ন ওষুধ উত্পাদনকারী ৪২টি কোম্পানির উত্পাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ইতালি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সুইজারল্যান্ডসহ ১০৯টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। জাপানও বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানির আগ্রহ ব্যক্ত করে। রাজধানীর মিটফোর্ড পাইকারি ওষুধের বাজারে বছরে বিক্রি হয় ২০০০ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি ওষুধ। বাংলাদেশের ওষুধের সুনাম এখন বহির্বিশ্বেও। দেশেই ওষুধের বাজার রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মিটফোর্ড ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, চোরাচালানের মাধ্যমে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিদেশি ওষুধ আসছে দেশে। এ চোরাচালান ঠেকানো সম্ভব হলে দেশে ওষুধের বাজার চাহিদা আরও সম্প্রসারণ হবে। ওষুধ সমিতির তথ্যে দেখা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৩ লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে। তার মধ্যে অবৈধ দোকানের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। লাইসেন্সবিহীনভাবে তারা ওষুধের ব্যবসা করছে। মিটফোর্ড ছাড়াও দেশে আরও পাঁচটি বড় ওষুধের মার্কেট রয়েছে— খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। সব মিলিয়ে ওষুধ উত্পাদন, বিপণন ও খুচরা বাজারজাতের সঙ্গে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি সম্পৃক্ত। বিপণন কর্মকাণ্ডে কয়েক লাখ শিক্ষিত তরুণের অংশগ্রহণ এ শিল্পকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। সম্প্রতি দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের কার্যকর মৌলিক উপাদান উত্পাদনে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো যৌথ প্রযুক্তি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ওষুধের কাঁচামাল তৈরিতে এগিয়ে আসছে। এ রকম ২১টি কোম্পানির মধ্যে আনুমানিক ৪১টির মতো ওষুধের কার্যকর মৌলিক উপাদান তৈরি ও বাজারজাত করছে বলে জানা গেছে। ওষুধশিল্পের কাঁচামালের স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় একটি ওষুধ শিল্প পার্ক গড়ে তোলার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন বাউশিয়া ও লক্ষ্মীপুর মৌজায় ২০০ একর জমির ওপর ওষুধ শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। নানা জটিলতা ও প্রতিকূলতার কারণে ওই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন ২০১৬-তেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল উত্পাদনের জন্য এ পার্কে ৪২টি প্লটে শিল্প স্থাপিত হবে। সরাসরি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে প্রায় ২৫ হাজার লোকের।