রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

অতি উৎসাহে সর্বনাশ

ব্লগার হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অতি উৎসাহী ব্লগাররা উগ্রপন্থিদের টার্গেটের শিকার হচ্ছেন। হুমকি-ধমকিতে তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলার পর এক পর্যায়ে খুব ঠাণ্ডা মাথায় তাদেরকে নির্মমভাবে খুন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচনায় আসার চেষ্টা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করছেন। অনেকে না বুঝেই ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করে— এমন লেখালেখি করে থাকেন। যারা বিদেশে পাড়ি জমানোর মতলবেও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ব্লগে লেখালেখি করেন, তাদের সংখ্যাও কম নয়। বেশ কিছু দেশের ভিসা পেতে এমন অনেকেই আবেদন করেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। তাদের মতে, যারা দেশ ত্যাগ করেছেন, তাদের অনেকেই আবার বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এমন বেশ কয়েকজন ব্লগারের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, অনেকে শখের বশে ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন। এমন কিছু বিষয় তারা বেছে নেন, যেগুলো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এবং ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে ব্লগারদের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বক্তব্য দেওয়াটা অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আলাদা একটি সেল ব্লগারদের এমন মন্তব্যের ওপর নিয়মিত নজরদারি করছে। ব্লগাররা ব্লগে স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে মন্তব্য করছে কিনা, কারও অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে কিনা— সেগুলো খেয়াল রাখছে সেলটি।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার যেমন কারও অধিকার নেই, তেমনই কাউকে হত্যা করা সবচেয়ে বড় অপরাধ।

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ব্লগাররা যা লিখছে সেটিও ঠিক বলে আমি মনে করি না। কারণ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। তিনি মনে করেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে দেওয়া ব্লগারদের বক্তব্য, মতামত উপেক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত। তিনি এও বলেন, উগ্রবাদীদের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা চলতেও দেওয়া যায় না।  বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি কাজী মাওলানা মুহম্মদ আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে মারামারি হানাহানির কোনো স্থান নেই। ব্লগে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদের আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু তাদের হত্যা করা আমরা সমর্থন করি না। ব্লগারদের যারা হত্যা করেছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছে, এসব খুনের সঙ্গে ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন জড়িত। অনেককেই গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা হয়েছে। যাদের এখনো গ্রেফতার করা যায়নি, তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যারা খুনের শিকার হওয়ার হুমকির মধ্যে রয়েছেন তাদের অনেকেই ভিন্ন নামে ব্লগে লেখালেখি করে থাকেন। অনেকের লেখাতে ইসলামবিরোধী মনোভাব থাকায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তালিকায় থাকা ব্লগাররাসহ অনেকেই ছদ্মনামে ব্লগে লেখালেখি করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে থেকে লেখেন। তারা যখন দেশে ফেরেন তখন পুলিশকে তথ্য দেন না। এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে যায়। এর বাইরে ব্লগার, প্রকাশক এবং মুক্তমনা লেখকদের বিষয়ে পুলিশের নিজস্ব নজরদারি আছে। যারা হুমকিতে আছেন বলে পুলিশের কাছে মনে হয় তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। অনেকে থানায় জিডি করে নিরাপত্তা চান। আবার অনেকে জানাজানি হলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এ আশঙ্কায় জিডি করতে চান না। তারা ব্যক্তিগতভাবে ডিবি পুলিশ, থানা পুলিশ বা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা চান। তাদের নানাভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ আবার দৃশ্যমান নিরাপত্তা পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন এতে তাদের প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ কৌশলে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।

জানা গেছে, নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) হিটলিস্টে থাকা ৮৪ ব্লগারের একটি তালিকা অনেক দিন আগেই পেয়েছে পুলিশ। ওই তালিকায় ছিলেন ড. অভিজিৎ রায়, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, রাজীব হায়দার শোভন ও অনন্ত বিজয় দাসের নাম। যারা ঘাতকদের পরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, তালিকায় এমন ব্লগারদেরও নাম রয়েছে, যারা না বুঝেই ব্লগিং করে থাকেন।

তালিকায় থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি— জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিশনাল আইজি) সমমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ব্লগারদের হত্যার ‘তালিকায়’ অধিকাংশ ব্লগারের ফেসবুকের নাম আর ব্লগিং আইডি দেওয়া আছে। সবার আইডির নাম খুঁজে বের করে নিরাপত্তা দেওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই যাদের নাম ওই তালিকায় রয়েছে তারা যদি নিজেরাই পুলিশের কাছে এসে নিরাপত্তার বিষয়টি জানান তাহলে ভালো হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর