রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

অবাধে চলছে বিদেশি অবৈধ বিলাসী গাড়ি

পোরশে মার্সিডিজ বিএমডব্লিউ ফেরারির ছড়াছড়ি মালিকদের ধরতে অভিযান শুরু

রুহুল আমিন রাসেল

অবাধে চলছে বিদেশি অবৈধ বিলাসী গাড়ি

শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা অবৈধ বিলাসী গাড়ি অবাধে চলছে। এমন দেড় শতাধিক গাড়ির মালিককে ধরতে অফিস, বাসা-বাড়ি ও রাস্তায় অভিযানে নেমেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। গুলশানে গত সপ্তাহে একটি গাড়ি আটকের পর শুল্ক ফাঁকি দেওয়া এসব গাড়ির ব্যবহারকারীরা সতর্ক হয়ে গেছে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ‘কার নেট দ্য পেসেজ’ এর আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় দেশে নিয়ে আসা গাড়ি হাতবদল করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যবহার করছে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পেশাজীবীরা। বিভিন্ন জাল দলিলের মাধ্যমে গাড়িগুলো ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব গাড়ির কোনো কোনোটি ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের নম্বর প্লেট নিয়ে রাস্তায় চলে। কোনো গাড়ি আবার চলছে নম্বর প্লেট ছাড়াই। এসব দামি গাড়ির মালিকদের অনেকেরই ব্যবসা কী কেউ জানে না। নিয়ম অনুযায়ী এসব গাড়ি পর্যটকের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই সুবিধায় তিন শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি বাংলাদেশে ঢুকলেও ফিরে গেছে মাত্র ১৫০। বাকি দেড় শতাধিক গাড়ি মালিকানা বদল করে জাল দলিল ও ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব গাড়ি ও মালিকদের খুঁজছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সূত্র জানায়, কেবল ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নয়, শিক্ষক এবং শোবিজ তারকারাও ব্যবহার করছেন অবৈধভাবে আনা দামি বিলাসী গাড়ি। উত্তরা-বারিধারা-গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় বসবাসকারীদের এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে রোলস রয়েস, বিএমডব্লিউ-পোরশে, মার্সিডিজ ইত্যাদি। এসব গাড়ির মালিক কারা— তাদের খুঁজছে শুল্ক গোয়েন্দারা। সংস্থাটি জানিয়েছে, এমন গাড়ি উদ্ধার ও মালিকদের ধরতে অফিস, বাসা-বাড়ি ও রাস্তায় এখন অভিযান চলছে। সিলেটের রাস্তায় চলাচলকারী দুই  কোটি টাকা মূল্যের একটি ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’ শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের আগেই সম্প্রতি উধাও হয়ে গেছে। আলোচিত ওই গাড়ির খোঁজে সিলেটে চলছে অভিযান। গত বৃহস্পতিবার আম্বরখানার বিএম টাওয়ারে গিয়ে বি-৩ ফ্ল্যাটের পার্কিংয়ে একটি ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’ গাড়ি (ঢাকা-৬১৪/ও) দেখতে পায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একটি টিম। টাওয়ারের বাসিন্দা প্রবাসী আবদুল মালেক ওই গাড়ি ব্যবহার করেন। কয়েক মাস আগে তিনি গাড়িটি সিলেটে নিয়ে এসেছেন। গতকাল গাড়িটি আটক করতে গিয়ে আর সেটি পাননি গোয়েন্দারা। সিলেটের আরও কয়েকটি অবৈধ গাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব গাড়ি ধরতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে। শখের গাড়ি নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে সিলেটে। বিশেষ করে ব্রিটেনের রাস্তার গাড়িগুলো ‘কার নেট দ্য পেসেজ’ এর আওতায় শখ করে সিলেটে নিয়ে আসেন প্রবাসীরা। পরে সেগুলো অবৈধ প্রক্রিয়ায় হাতবদল হয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা চার কোটি টাকা মূল্যের দুটি পাজেরো আটক করেছিল পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আপাতত দেড় শতাধিক গাড়ির খোঁজে মাঠে সক্রিয় আছে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রথমত আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনাদের কাছে অবৈধ গাড়ি থাকলে দ্রুত জমা দিন। রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধভাবে দেশে আনা গাড়ি যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই আটক করা হবে। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, কারনেট সুবিধার নামে অসংখ্য গাড়ি দেশে আছে। এসব গাড়ি কীভাবে বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন পেল, তাও খতিয়ে দেখা উচিত। লন্ডন আমেরিকা থেকে গাড়ি এনে দেশে ৬ মাস ১ বছর ব্যবহার করার কথা বলে, বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কাস্টমস এভাবে শুল্কমুক্ত গাড়ি ছেড়ে দিলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। জানা গেছে, এ ধরনের গাড়ি ব্যবহার করে ধরা পড়লে অনেক সময়ে সরকারের প্রাপ্য শুল্ক নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার অনেক সময়ে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সঙ্গে পণ্য-মূল্যের ১০ গুণ পর্যন্ত জরিমানা করার আইন রয়েছে। এ ছাড়া অপরাধীর বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে এবং ফৌজদারি আইনেও বিচার করা হবে। এর শাস্তি ১২ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা দুটিই হতে পারে। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, অবৈধ গাড়ি ধরতে সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে এই অভিযান চলবে। দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতেই এই চিরুনি অভিযান চলছে। এদিকে এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে তাদের ধারণা ছিল, কেবল বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাই কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভেঙে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের একজন শিক্ষক ও শোবিজ জগতের এক তারকার কাছ থেকে অবৈধভাবে ব্যবহার করা বিলাসী গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার দেশের একজন সেলিব্রেটি মডেলের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা দামের একটি অবৈধ গাড়ি আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। শুল্ক গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পোরশে মডেলের ব্রিটিশ রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে বাংলাদেশ আনা এই গাড়িটিতে দীর্ঘ দিন নজরদারি রাখা হয়েছিল। গত ৪ এপ্রিল মিথ্যা ঘোষণা ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা তিন কোটি টাকা দামের বিএমডব্লিউ এক্স—ফাইভ মডেলের একটি গাড়ি রাজধানীর গুলশান থেকে আটক করে শুল্ক গোয়েন্দারা। এই গাড়িটি ব্যবহার করতেন বুয়েটের শিক্ষক কাজী ফাহরিবা মোস্তফা। শুল্ক গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী কাজী রেজাউল মোস্তফার গুলশান-২ এর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা গাড়িটি আটক করা হয়। এই গাড়িটি প্রতিবছর বিআরটিএ হতে রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করা হয়েছে। এর আগে গত ১০ মার্চ ৩৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ৪টি গাড়ি অবৈধভাবে আমদানি করায় দুবাই এভিয়েশন করপোরেশনের বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। গত বছর ৩ এপ্রিল ধানমন্ডির ২৩/এ, রোড নং-৫, বাড়িতে অভিযান চালিয়ে শুল্ক ও কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে আনা বিলাসবহুল একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি আটক করে শুল্ক গোয়েন্দারা। গাড়িটির মালিক বেলায়েত হোসেন। ওই গাড়িটির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানায় গত বছর ৫ অক্টোবর একটি মামলা হয়েছে। অপরদিকে গত বছর ৭ মে একই নম্বর প্লেট ব্যবহার করায় রাজধানীর বনানী ও উত্তরা থেকে দুটি গাড়ি আটক করা হয়েছে। এর একটি টয়োটা প্রাডো জিপ ও অপরটি বিএমডব্লিউ। গাড়ি দুটিতে ব্যবহূত নম্বর প্লেট ছিল ভুয়া।

সর্বশেষ খবর