মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাঁচ কারণে এই পরিস্থিতি

বিশেষজ্ঞ মত

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি সেবার মানহীন কাজের পেছনে পাঁচ কারণকে দায়ী করছেন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞরা। কারণগুলো হলো—সুশাসনের অভাব, দলীয়করণ, দুর্নীতি, মনিটরিং ও অদক্ষদের হাতে কাজের দায়দায়িত্ব তুলে দেওয়া। তাদের মতে, প্রশাসন সর্বস্তরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনে দলীয়করণ তো আছেই। সরকারের উন্নয়ন-সংশ্লিষ্টরা সঠিকভাবে কার্যক্রম মনিটর করতে পারলে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘এখন যেসব ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, তাদের নির্মাণ-সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর তারাই মনে করেন যে, নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশ দিলে কোনো ক্ষতি নেই। অথচ যে কোনো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাজ সুপারভিশন হওয়ার কথা। ছোট কন্ট্রাকটররা সাধারণত সব সময় এ কাজগুলোর তত্ত্বাবধান করেন। আর তার ওপরের কন্ট্রাকটররা এ কাজগুলোর তত্ত্বাবধান করেন মাঝেমধ্যে।’

তিনি বলেন, ‘এখন সব লেভেলেই গাফিলতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  কাজের তত্ত্বাবধান না থাকায় কিছুদিন পরই নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা অবকাঠামোগুলোর কংক্রিট খসে পড়তে শুরু করে। তখন এগুলো আবারও তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অথচ দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে যে ঠিকাদাররা দায়িত্বে থাকেন, তাদের সবাকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এস এম হার্িলম বলেন,  ‘সরকারের সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ, দুর্নীতির কারণে মানহীন কাজ চলছে। সরকার সুষ্ঠুভাবে কোনো কিছুই মনিটর করছে না। যেসব জায়গায় ত্রুটি আছে, কে করল, কেন করল—তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। এসব কারণে অপরাধীরা আরও প্রশ্রয় পায়। এ ছাড়া অদক্ষদের ঢালাও পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনের মাথা ভারী করা হয়েছে। অথচ প্রশাসনের নিচের স্তর লোকবলশূন্য। এভাবে চলতে পারে না। সব সেক্টরেই জবাবদিহি থাকতে হবে।’ সাবেক আরেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘মানহীন সরকারি কাজের মূল কারণ হচ্ছে সুশাসনের অভাব। এ ছাড়া প্রশাসনে দলীয়করণ তো আছেই। এ দুই অভাব দূর করতে পারলে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।’ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, “আগে আমাদের বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামো পিডব্লিউডি (পাবলিক ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট) নামক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে তৈরি হতো। এ প্রতিষ্ঠানটি যে একদম চুরি করত না তা নয়। তবে তারা কতটা চুরি করলে ভবনের ক্ষতি হতে পারে তা জেনেই তৈরি করত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ‘আমার কাজ আমি করব’ এ মনোভাব থেকে নিজেরাই লোক নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন ভবন নির্মাণের কাজ করছে। আর নতুন যে প্রতিষ্ঠানগুলো ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, তারা চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ কাজগুলো করছে। তারা ৯০% চুরি করে আর বাকি ১০% কাজ করে, যাকে আমরা ‘পুকুরচুরি’ বলে থাকি।” তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এখন যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই অবকাঠামো তৈরি করার কাজ দিচ্ছে, তাদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। ফলে তাদের ব্যবস্থাপনার মধ্যেই নানা ধরনের ত্রুটি আছে। এরা আগেই সেই নির্মাণকাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে নিজের ভাগে কত অংশ পড়বে তা নিয়ে ভাবে। পিডব্লিউডি ছাড়াও এলজিইডি (লোকাল গভর্নমেন্ট ডিভিশন) এই সরকারি ভবন নির্মাণ করত। এদেরও মানসম্পন্ন প্রকৌশলী আছে। তারা জানেন চুরি করার পরও একটি ভবনকে মজবুতভাবে তৈরি করতে হলে কী করতে হবে, যা বিভিন্ন বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো জানে না। এসব অর্থলোভী প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে প্রতিযোগিতায় নামে ঠিকই কিন্তু এসব কাজের কোনো  মান নেই। আমার মতে, সরকারি কোনো অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। এ ছাড়া পিডব্লিউডির আওতায় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিশেষায়িত কোনো বিভাগ খুলে সেখানকার প্রশিক্ষিত দক্ষ প্রকৌশলীদের সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।’ এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসান বলেন, ‘তদারকি ও দুর্নীতির কারণে অনেক সময় কাজের মান খারাপ হয়। এ জন্য সরকারের প্রফেশনাল ডিপার্টমেন্টের ওপর বিভিন্ন নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এ ছাড়া অনেক সময় পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে নির্মাণকাজ করা হয়। কিন্তু তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।’

সর্বশেষ খবর