বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

খুনি ধরা পড়ে অস্ত্র যায় কোথায়

আনিস রহমান

খুনি ধরা পড়ে অস্ত্র যায় কোথায়

রাজধানীর কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার, রংপুরে জাপানি কোনিও হোশি এবং মাগুরায় মায়ের পেটে থাকা শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোতে ব্যবহার করা আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি র‌্যাব কিংবা পুলিশ। আর এ অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারায় মামলাগুলোর অভিযোগপত্রও (চার্জশিট) পুলিশ আদালতে দাখিল করতে পারছে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নূরুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা অনেক কষ্ট করে আসামি গ্রেফতার করেন। মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করে চার্জশিট দেন। তবে ব্যবহূত অস্ত্রটি উদ্ধার করে চার্জশিটে ব্যালাস্টিক প্রতিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ না করা হলে বিবাদীপক্ষ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। মামলার রায় নিজেদের পক্ষে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তাই তদন্ত কর্মকর্তাকে ব্যবহূত অস্ত্রটি উদ্ধারের জন্য পরামর্শ দেন তিনি। বিডিআর বিদ্রোহ মামলা পরিচালনাকারী স্পেশাল পিপি মুনজুর আলম মঞ্জু বলেন, খুনের সময় ব্যবহার করা অস্ত্র উদ্ধার না করতে পারা তদন্ত কর্মকর্তার অযোগ্যতা। বিচারের সময় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিলে তা আদালত গ্রহণ করেন। তবে অস্ত্র উদ্ধার হওয়াটা ন্যায়বিচারের জন্য ভালো। গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর গুলশানে গুলি করে হত্যা করা হয় ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজারকে (৫১)। এ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত পিস্তল না পাওয়ায় মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিতে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবি বলেছে, অভিযোগপত্র প্রস্তুত থাকলেও আটকে আছে কেবল পিস্তলের কারণে।

এদিকে সিজার হত্যা মামলায় আসামিদের মধ্যে দুজন তামজিদ আহমেদ রুবেল ও রাসেল চৌধুরী ইতিপূর্বে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। গ্রেফতার থাকা অন্য তিনজনের পরিবারও দাবি করেছে, ওই তিনজনও সিজার হত্যায় জড়িত নন। মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবির সূত্র বলেছে, তাবেলা সিজার হত্যায় ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এম এ কাইয়ুম, তার ভাই আবদুল মতিনসহ সাতজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। অন্যরা হলেন তামজিদ আহমেদ রুবেল, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল আরেফিন, শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ ও ভাঙ্গারি সোহেল। এই সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত রয়েছে। এদের মধ্যে কাইয়ুম ও ভাঙ্গারি সোহেল ছাড়া বাকি সবাই গ্রেফতার আছেন। একই বছর ৩ অক্টোবর সকালে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ৬৬ বছরের কোনিও হোশি। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর নিহতের ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হীরা, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান ওরফে মেরিল সুমন, নওশাদ হোসেন ওরফে ব্ল্যাক রুবেল ও যুবলীগ নেতা কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজল গ্রেফতার হন।

ঘটনার দুই মাস পাঁচ দিনের মাথায় কোনিওকে জেএমবিই হত্যা করেছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের তত্কালীন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হুমায়ুন কবীর। পীরগাছা উপজেলা থেকে জেএমবির রংপুরের আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা, সহকারী আঞ্চলিক কমান্ডার খয়বর হোসেন ও এহসার সদস্য ইসাহাক আলীকে গ্রেফতার করে তাদের ওই মামলায় আসামি করা হয়। এদের মধ্যে মাসুদ রানা ও ইসাহাক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে ডিআইজি হুমায়ুন কবীর তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে জানান, জেএমবির কমান্ডার ইসাহাক আলী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, ইসাহাক, মাসুদ রানা ও খয়বর একটি মোটরসাইকেলে করে ৩ অক্টোবর ঘটনাস্থল আলুটারি গ্রামে যান। মাসুদ রানা কোনিওকে গুলি করেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা অস্ত্র সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য দেননি। শুধু তা-ই নয়, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৫ জন। এই সহিংসতার ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের অবৈধ অস্ত্রের গুলিতেই বেশির ভাগ নিহতের ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, নাশকতা ও সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনার পরও এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ৩০ মার্চ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় ৯ বছরের শিশু শুভ কাজী। এ ঘটনার পর পুলিশ অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করে। কিন্তু আজও গ্রেফতার হয়নি হত্যাকারীরা। উদ্ধার হয়নি আগ্নেয়াস্ত্র। মাগুরায় মায়ের পেটে থাকা শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হলেও অস্ত্রের বিষয়টির সুরাহা হয়নি। আর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা অস্ত্রগুলো দীর্ঘদিনেও উদ্ধার না হওয়ায় মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দিতে পারছে না। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, খুনিদের গ্রেফতার বা শনাক্ত করা গেলেও অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় আদালতে চার্জশিট দিতে কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে। গত বছর ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের কারিগরপাড়ায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় গৃহবধূ নাজমা খাতুন (৩৫) গুলিবিদ্ধ হন। একই ঘটনায় তার চাচাশ্বশুর মমিন ভূঁইয়া (৬৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই সময় নাজমা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গুলি তার গর্ভের শিশুকেও এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। পরে মাগুরা সদর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে নাজমা গুলিবিদ্ধ কন্যাশিশুর জন্ম দেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার কন্যাশিশুকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় এক মাস চিকিৎসা শেষে মা ও শিশু মাগুরায় ফিরে যায়। ওই ঘটনায় হওয়া মামলার পাঁচ মাস পর ১ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে মামলার প্রধান আসামি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সেন সুমনসহ এজাহারভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১৪ জন এবং এজাহারের বাইরে আরও তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু যে অস্ত্রের গুলিতে একজনের মৃত্যু ও মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ হয়, দীর্ঘদিনেও সেই অস্ত্রটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। চার্জশিটে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ওই গোলাগুলির ঘটনার নেপথ্য মদদদাতাদের শনাক্ত করা বা তাদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

আরও কিছু ঘটনা : ১৩ ফেব্রুয়ারি কাফরুলে বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে ১৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ২৮ ফেব্রুয়ারি বংশালের সুরিটোলায় ইউসুফ নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৮০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। ৫ মার্চ আগারগাঁও তালতলায় বিকাশ এজেন্ট সাইদুল ইসলামের পায়ে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। একই দিন লালবাগের কাজী রিয়াজউদ্দিন রোডে ব্যবসায়ী তাসরিদের রিকশা থামিয়ে তার পায়ে গুলি করে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ১৩ মার্চ রাজধানীর রামপুরার হাজীপাড়ায় স্যানিটারি সামগ্রী দোকানের ম্যানেজার ইসমাইল হোসেনকে গুলি করে হত্যার পর তিন লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। ৯ এপ্রিল দুপুরে ডিবি পরিচয়ে দুই যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাত লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছেও ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায়ই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহূত হলেও উদ্ধার হয় না এসব।

সর্বশেষ খবর