সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি

‘টাকার দালালি করিস না, যারে তারে নৌকা দিস না। নতুন কোনো ব্যবসা ধর, নমিনেশন বাণিজ্য বন্ধ কর’— এই স্লোগান দিয়ে গত শুক্রবার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। শুধু চট্টগ্রামই নয়, এর আগে বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় দলীয় কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর করা হয়। এ অভিযোগ মনোনয়ন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই। তবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের তৃণমূলের এই ‘মনোনয়ন বাণিজ্যের’ অভিযোগ কর্ণপাত না করলেও চতুর্থ ধাপ থেকে অভিযোগের সত্যতা যাচাই-বাছাই করছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। ঘটনার সত্যতা     মিললে সাংগঠনিক পদ হারাবেন সংশ্লিষ্টরা। এর পাশাপাশি দলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তাকে। দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ নেতারা এমন আভাস দিয়েছেন। তৃণমূল থেকে আসা অসংখ্য অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই জমা পড়ছে ধানমন্ডির সভাপতির কার্যালয়ে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার ফেনীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কিছু কিছু এলাকায় প্রার্থী মনোনয়নে টাকা নিচ্ছে— এমন অভিযোগ একদম অসত্য নয়। এসব ব্যাপারে যাচাই-বাছাই হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র মতে, নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী বাছাইয়ে চলছে টাকার খেলা। সবার ধারণা, ছলে-বলে-কৌশলে নৌকাতে উঠতে পারলেই দরিয়া পার। নৌকা মানেই যেন বিজয়ের মালা গলায় পরা। তাই নৌকা প্রতীক পেতে প্রার্থীরা যেন মরিয়া। আর এমন প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়েই চলছে রমরমা মনোনয়ন বাণিজ্য। কোন প্রার্থী কত টাকায় নৌকার টিকিট পেলেন— তা এখন সবার মুখে মুখে। প্রার্থী প্রতি ১০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন এমপি, জেলা ও উপজেলা নেতার বিরুদ্ধে। ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ত্যাগী ও দলের প্রতি নিবেদিত নেতাদের বাদ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অন্যদের মনোনয়ন দেওয়ার সুুপারিশ করা হয়েছে— এমন অভিযোগ পেয়ে রীতিমতো বিস্মিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের মনোনয়নেও প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। দলের সিদ্ধান্ত ছিল এমপিদের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় রাখা হবে না। তবে কাগজ-কলমে না থাকলেও অনেকাংশেই মূল ছড়ি তারাই ঘোরাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা এসব মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়ে পড়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। কোথাও কোথাও বিশেষ সিন্ডিকেট তৈরি করে নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্যের অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ একক কর্তৃত্ববলেই মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। মনোনয়ন বাণিজ্যের অর্থ পকেটে পুরছেন অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রীও। আর এ কারণে অনেক ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও অর্থের কাছে তারা হেরে যাচ্ছেন। তাদের অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

শুধু বিতর্কিত নয়, সদ্য বিএনপি-জামায়াত থেকে যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগ নামধারীদেরও অর্থের বিনিময়ে নৌকা প্রতীক দেওয়া হচ্ছে। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মানববন্ধন করছেন, সংবাদ সম্মেলন করে সঠিক চিত্র তুলে ধরছেন, দলের হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। সংঘর্ষেও লিপ্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিভিন্ন গ্রুপ। গত শুক্রবার চট্টগ্রাম সকালে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকায় অবস্থিত দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা চালায় মনোনয়ন বঞ্চিতরা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পটিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার মোট ১৬ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া চলে আসছিল। গত ১৩ এপ্রিল তৃণমূল কর্মীদের ভোটে মনোনীতদের একটি তালিকা জেলা আওয়ামী লীগের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু তৃণমূল থেকে নির্বাচিতদের তালিকা পাশ কাটিয়ে নিজেদের পছন্দের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাত্কার ডাকা হয়। এতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, চতুর্থ ধাপে দলীয় মনোনয়নের জন্য নড়াইলের ভদ্রবিলা ইউনিয়নে শাহীদুর রহমান মিনার নাম প্রস্তাব করে পাঠানো হয়। দলের মনোনয়ন বোর্ড তার প্রার্থিতা চূড়ান্তও করে। কিন্তু এক দিন পরই তার নাম পরিবর্তন করে সেখানে আবিদ আল হাসানের নামে চিঠি ইস্যু করা হয়। এলাকায় তার তেমন গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও কেন্দ্রীয় এক নেতার বদৌলতে তিনি এবার মনোনয়ন পেয়ে যান। জেলার এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন নেতারা ঐকমত্য হয়ে সাইদুর রহমান মিনার নাম পাঠালেও বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় এক নেতা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রার্থী পরিবর্তন করেছেন। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় শংকরপুর ইউনিয়নে তৃণমূল থেকে পাঠানো হয়েছিল অধ্যাপক শরিফুল ইসলামের নাম। তার নাম পরিবর্তন করে গোবিন্দ চ্যাটার্জি নামের আরেকজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা। গদখালীতে তৃণমূল পাঠিয়েছিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান আলীর নাম। সেখানে পরিবর্তন করে যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম খোকনকে প্রার্থী করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে নানা অভিযোগ রয়েছে। গঙ্গনন্দপুরে তৃণমূলে প্রার্থী করা হয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বদরউদ্দিনকে। তার পরিবর্তে গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে যিনি কাজ করেছেন সেই আমিনুল ইসলামকে প্রার্থী করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জেলার এক শীর্ষ নেতা ও কেন্দ্রীয় এক নেতা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তৃণমূলের পাঠানো নাম পরিবর্তন করে বিতর্কিত ব্যক্তিদের প্রার্থী করা হয়েছে। এতে করে ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, যিনি জাতীয় নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করলেন, তাকে এখন নৌকা প্রতীক দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো। এতে অন্যায়কারীরা অন্যায় করতে আরও উৎসাহিত হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সতীশ চন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেসব অভিযোগ কেন্দ্রে জমা পড়ছে-সে অভিযোগের পেছনে দৌড়ালে চলবে না। সঠিক তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে তৃণমূল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

সর্বশেষ খবর