রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

কান্না থামেনি এখনো

অনেকে পঙ্গু, অনেকে মানসিক রোগী

নাজমুল হুদা, সাভার

কান্না থামেনি এখনো

রানা প্লাজা ধসে নিহত স্বজনের কবর ছুঁয়ে গতকাল কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। রাজধানীর জুরাইন কবরস্থান থেকে তোলা ছবি —রোহেত রাজীব

আজ ২৪ এপ্রিল। দেশের পোশাকশিল্পে এক শোকাবহ দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৪৩ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ঘটে। ওই ঘটনায় আহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। এ দিনটিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত রানা প্লাজায় তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো ওই দিন সকাল ৮টার হাজির হন নিজ নিজ কর্মস্থলে। উত্পাদনও শুরু করেন নির্ধারিত সময়ে। হঠাৎ ৮টা ৪৫ মিনিটে বিকট শব্দ। আশপাশে উড়তে থাকে ধুলোবালি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা। শুরু হয় আহত শ্রমিকদের আহাজারি। উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান। সেদিন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ১৪৩ জন শ্রমিকের মৃতদেহ। একই সঙ্গে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিককে। আহতদের মধ্যে অনেকেই সারা জীবনের জন্য বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। অনেকে পরিণত হয়েছেন মানসিক রোগীতে। এ ঘটনার জন্য ওই সময় স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতিকেই দায়ী করেছিলেন সুশীল সমাজ ও আহত শ্রমিকরা। তারা দাবি করেন, ভবনটি ধসের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই ফাটল দেখা দিয়েছিল চতুর্থ ও পঞ্চম তলার কয়েকটি পিলারে, যা দেখে তারা কর্মস্থল থেকে নেমে আসেন মহাসড়কে। এমন সংবাদের পর সেখানে ছুটে যান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। তবে সংবাদকর্মীদের ওই স্থানে প্রবেশ করতে দেয়নি মালিক কর্তৃপক্ষ। এ সময় সংবাদকর্মীরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে। সংবাদ প্রচারিত হয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। পরে ওই দিন বিকালেই ভবনের ফাটল দেখতে আসেন তত্কালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদার।

কালের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুলমাঠ : অনন্ত বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ। ঘটনার দিন থেকে টানা ১৭ দিন ওই বিদ্যালয়ের মাঠে নিহতদের নিয়ে রাখা হতো। আর স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হতো সেই মাঠ থেকে। প্রিয় মানুষটির সন্ধান পেতে স্বজনরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। রানা প্লাজা থেকে বিদ্যালয়ের মাঠ পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সে সময় অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু শব্দ সবার হূদয় স্পর্শ করে যেত। যখনই অ্যাম্বুলেন্স আসত অপেক্ষমাণ স্বজনরা পড়তেন হুমড়ি খেয়ে। এই বুঝি এলো প্রাণের মানুষটি! আজও সেই মাঠটি আছে। তবে নেই সেই চিত্র। তবে মাঠটি যেন আগের মতো আর হাসছে না। প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলেছে। শোক কাটছে না তার বুক থেকে। আগের মতো সবাই মাঠে এসে খেলার আয়োজন করছে না। অহেতুক কেউ আর আড্ডা দিচ্ছে না মাঠের কোণে।

রানা প্লাজার বর্তমান চিত্র : অধিকাংশ ধ্বংসস্তূপই সরিয়ে নিয়ে ফেলা হয়েছে বংশাই নদীর পাড়ে। এখনো কনক্রিটের সুরকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে রানা প্লাজার ১৮ শতাংশ জমির ওপর। চারপাশ কাঁটাতার আর টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছিল জেলা প্রশাসন। তাও আজ মিশে গেছে। সামনেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে শহীদ বেদি। প্রায় প্রতিদিনই রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর নিখোঁজদের স্বজনদের আনাগোনা এখানে চোখে পড়ে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানা দাবিতে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে চালিয়ে আসছে আন্দোলন।

রানার সব ভূমি সরকারের দখলে : সোহেল রানার মালিকানাধীন রানা প্লাজার ভূমি, রানা টাওয়ারের ভূমি ও ধামরাইয়ের রানা ব্রিকসের ভূমি সরকার দখলে নিয়েছে। আদালতের নির্দেশে রানার মালিকানাধীন সব ভূমি বাজেয়াপ্ত করে দখল বুঝে নিয়েছে ঢাকা জেলা প্রসাশন।

শ্রমিকনেতাদের দাবি : রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিরাপদ রাখতে শুরু করে আন্দোলন। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিংয়ের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও করেন তারা। একই সঙ্গে তারা দাবি করেন, ২৪ এপ্রিলকে যেন জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের আশুলিয়া থানার সভাপতি মো. ইব্রাহিম বলেন, রানা প্লাজার অনেক শ্রমিক রয়েছেন, যারা এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

দ্রুত ওই সব শ্রমিককে লস অব আর্নিংয়ের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক। এ ছাড়া সরকার সোহেল রানার যেসব সম্পত্তি জব্দ করেছে, তা নিহত ও আহতদের পরিবারের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হোক। তা না হলে আবারও শ্রমিকসমাজ এক হয়ে আন্দোলনে নামবে।

সর্বশেষ খবর