শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চাইলেন ব্যবসায়ীরা

বাণিজ্য পরামর্শক সহায়ক কমিটির সভা

নিজস্ব প্রতিবেদক

শীর্ষ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ ও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় ব্যবসায়ীরা এ দাবি জানান। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের পর দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের আর কোনো সংকট থাকবে না। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশেও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা হবে। সভায় ব্যবসায়ীরা বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে চাইলে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে তা সংশোধন করতে হবে। ভ্যাট আদায়ের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা যাবে না। আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর কমাতে হবে। এসবের নিশ্চয়তা না থাকায় গত দুই বছরে কর্মসংস্থান কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিরও বিরোধিতা করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে বিমানবন্দরের কার্গো সার্ভিসের মান। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বক্তব্য রাখেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়াতুল্লাহ আল মামুন, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বিদ্যুৎ সচিব মানোয়ার ইসলাম, এফবিসিসিআইর সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, সাবেক সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, সালমান এফ রহমান, মীর নাসির হোসেন, এ কে আজাদ, বিজিএমএইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান, অ্যামচেম সভাপতি নুরুল ইসলাম, উইমেন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সেলিমা আহমাদসহ প্রায় সব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। অর্থমন্ত্রী বৈঠকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব বলেন, শুধু বাসাবাড়ি ও গাড়িতে ব্যবহূত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে কল-কারখানায় ব্যবহূত গ্যাসের দাম বাড়বে না। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা যখন ব্যবসা-বিনিয়োগের পরিকল্পনা করবেন, তখন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাবে এটি মাথায় রাখবেন। আগে থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে থাকবেন, তা ঠিক নয়।’ গত সাত বছরেও এলএনজি টার্মিনালের কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জ্বালানি সচিবকে উদ্দেশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আমরা ফেইল করেছি। এখন দয়া করে বলুন। তারিখ ধরে বলুন। কবে নাগাদ এ টার্মিনালের কাজ শেষ হবে আর গ্যাস সমস্যার সমাধান  হবে।’ আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া ভ্যাট আইনে এফবিসিসিআই ও এনবিআরের যৌথ পরামর্শক কমিটির সুপারিশ করা সাতটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবসায়ীরা অনুরোধ করেন। পৃথক বৈঠকে এ আইন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা পণ্য উত্পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের সঠিক হিসাব রাখলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট তাদের কাছে খুবই সহনীয় বলে মনে হবে। তবে নতুন আইন বাস্তবায়ন যাতে সহজ হয়, সে জন্যই সবার জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। তিন-চার বছর পর বিভিন্ন খাতে এটি কম-বেশি হবে। তাদের দাবি-দাওয়া শুনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন কার্যকর করা হলেও আমদানি পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি উঠে যাবে, তা নয়। দেশীয় শিল্পের স্বার্থ অবশ্যই সুরক্ষা করা হবে। করপোরেট করহার ৪৫ শতাংশ থেকে কিছুটা কমানো যেতে পারে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমার তথ্য উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হবে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, নির্মাণাধীন এলএনজি টার্মিনালের কাজ ইতিমধ্যে ৭৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যৌক্তিক রাখা এবং এ খাতের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি আগামী বাজেটে করপোরেট কর কমানোরও দাবি জানানো হয়েছে। দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বে অনেক পণ্যের দাম কমে গেছে। আমদানিকারকরা তা দেশে আনছেন। এতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারত আমাদের সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কাউন্টারভেইলিং শুল্ক আরোপ করে নিজেদের শিল্পের স্বার্থ রক্ষা করছে।’ ভ্যাট আইন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু যাতে আমরা না করি, যা ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রান্নার কাজ ও গাড়িতেই চাহিদার ২০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয়। এ খাত থেকে সরকার পায় মাত্র ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা। অথচ এই পরিমাণ গ্যাস শিল্প খাতে দিতে পারলে ৮০ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পাওয়া যেত। এ জন্য ধীরে ধীরে পাইপ লাইন গ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া চলছে, সে ধাপে রান্নার কাজে ও গাড়িতে ব্যবহূত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা রয়েছে। তবে সার ও বিদ্যুৎ উত্পাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহূত গ্যাসের দাম বাড়ানোর আপাতত কোনো চিন্তা নেই বলে জানান জ্বালানি সচিব। সালামান এফ রহমান বলেন, আগামী ১ জুলাই থেকে যে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন আসছে, তা কার্যকরের আগে সাতটি বিষয় সংশোধন করা প্রয়োজন। যে সাতটি বিষয়ে ব্যবসায়ীরা সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছেন সেগুলোর বিষয়ে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দেন, শিগগিরই তিনি শুধু মূসক আইনের এই সাতটি বিষয় নিয়ে বৈঠক করবেন। এ কে আজাদ বলেন, ‘শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সব মানুষই মূসক দিতে চায়। কিন্তু আমাদের দেশের মূসক আইন অত্যন্ত জটিল। এটিকে সহজ করতে হবে। মাত্র ১২ লাখ মানুষ কর দেয় এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।’ ৩৫ শতাংশ করপোরেট কর অনেক বেশি। আগামী বাজেটে এটিকে কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নানা সংকটের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। শর্ত সাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগ করার অনুমতির ব্যাপারেও অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ক্যাপটিক পাওয়ারে ব্যবহূত গ্যাসের দাম কমাতে হবে। আমদানিমূল্যে ডিজেল সরবরাহ করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়তে হলে পোশাক খাতকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানির বাধাগুলো দূর করতে হবে। সেলিম ওসমান বলেন, ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিতে হবে। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় বিনিয়োগকারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বলেন, ব্যাংকের অলস টাকা বিনিয়োগে আনতে হবে। জ্বালানি খাতের উন্নয়নে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। বিদ্যুতের গুণগত মান বাড়াতে হবে। ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনের সক্ষমতা আছে। কিন্তু তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাহলেই কেবল লোডশেডিং রোধ করা যাবে।

সর্বশেষ খবর