শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখতে হয় রাষ্ট্রের স্বার্থেই

----ড. কামাল হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

দেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন সংবিধান রক্ষায় আইনজীবীদের একসঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য বিভাগ— আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ। এগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। এ তিনটি বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রের অভিভাবক। রাষ্ট্রের স্বার্থেই বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখতে হয়। এ স্বাধীনতার ওপর হাত দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। নিজ নিজ স্বার্থে সংবিধানের ব্যাখ্যা করা  জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এটি সংবিধানের ওপরই হস্তক্ষেপের নামান্তর। অতীতে সংবিধানের ওপর হস্তক্ষেপ করে কেউ টিকে থাকতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। ড. কামাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেলেন। আইনজীবী সমিতির অডিটোরিয়ামে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. কফিল উদ্দিনের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সদস্য অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সিরাজউদ্দৌলা কুতুবী, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহাজাহান কবীর, আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুজিবুল হক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. এনামুল হক। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এস এম জাহেদ বীরু, অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাসেল। কামাল হোসেন বলেন, সবাই সব দল করতে পারেন। তবে সংবিধান, গণতন্ত্র আর মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, এমন কাজ না করাই ভালো। এটি করে পার পাওয়া যাবে না। অতীতেও আমরা সামরিক শাসকদের প্রতিরোধ করেছি, সংবিধান রক্ষা করেছি। আপনারা যে দলেরই হোন না কেন, সংবিধান নিয়ে এত কথা কেন? সংবিধানের এত ব্যাখ্যা কেন? আসুন এ সংবিধান রক্ষায় আইনজীবীরা একসঙ্গে বসি। সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিয়ে, অক্ষুণ্নতা নিয়ে, সংবিধান রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা দরকার। তিনি বলেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সরকার কেন তাড়াহুড়া করে মন্ত্রিসভায় তা পাস করে ফেলতে চায়, তার জবাব দিতে হবে। আগামী ৫ মে মামলাটির রায় হবে। এ মামলায় আদালতের আমন্ত্রণে আমি লিখিত মতামত দিয়েছি। খসড়া আইনের ওপর বিচারক, জজ, বিশ্লেষক, সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিনদের মতামত নিন। মতামত না নিয়ে, আলোচনা না করে পাস করলে বিচার বিভাগের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ড. কামাল হোসেন আরও বলেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তমতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়ার বিধান কার্যকর হলে দেশের বিচার বিভাগ ও সংবিধানের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এক মিনিটেই কেবিনেটে আইন পাস করলে হবে না। এটি যদি জনমত উপেক্ষা করে করা হয়, তবে তার ফল ভালো হবে না। বিচারক অপসারণ নিয়ে আইন প্রণয়ন প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেন, একজন বিচারককে যদি রায় দেওয়ার আগে তার চাকরি নিয়ে ভাবতে হয়, তাহলে সেখানে স্বাধীনতা থাকে না। একটি রায় বা আদেশ যদি কারও বিপক্ষে যায়, তবে ওই আদেশের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পক্ষ উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এটি তার অধিকার। প্রবীণ এ আইনজীবী বলেন, সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন। অনেক মূল্য দিয়ে তা অর্জিত হয়েছে। প্রতি বছর বিশেষ দিনে আমরা শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে যাই। আমাদের বর্তমানে আরও একটি জায়গায় যাওয়া উচিত। তা হচ্ছে জাতীয় জাদুঘর। সেখানে সংবিধানের দলিল সংরক্ষিত আছে। যাতে প্রথম স্বাক্ষর রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধু সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, জনগণ ক্ষমতার মালিক। এতে কারও দ্বিমত থাকতে পারে না। জনগণ ক্ষমতার মালিক তা কোনো দল বা গোষ্ঠীপ্রদত্ত নয়। তাই জনগণকে পাশ কাটিয়ে কেউ পার পেতে পারে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তিও পার পাননি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের স্বৈরশাসকও পার পাননি। কেউ ইচ্ছা করলে বা মনে করলে ক্ষমতায় চিরদিন থাকতে পারেন না। এটা মনে করাও ভুল। ’৯০ সালের আগস্টে এক স্বৈরশাসক আরও ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকবেন বলে দম্ভ করেছিলেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ পত্রিকায় সংবাদও ছাপা হয়েছিল। ওই সংবাদে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু তার দম্ভ ওই সংবাদের কয়েক মাস পরই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সরকার বিচারক অপসারণে যে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় পাস করেছে তা বিচার বিভাগের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ। এ আইনের ফলে বিচারকরা সব সময় আতঙ্কে থাকবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রকৃত বিচারপ্রার্থীরা। এ আইন প্রণয়ন না করে যোগ্য বিচারক নিয়োগে আইন করা দরকার।

সর্বশেষ খবর