শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপির মেয়ররা কেউ জেলে কেউ পলাতক

ম্যানেজ করে চলছেন একটি অংশ

মাহমুদ আজহার

বিএনপির মেয়ররা কেউ জেলে কেউ পলাতক

লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক আবদুল মান্নান। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে ২২টি মামলা দায়ের করে মেয়র পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মেয়র পদ ফিরে পান তিনি। এরপর গত ২৯ এপ্রিল দলীয় এক কর্মসূচিতে যোগদান করেন। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় গাড়ি পোড়ানোর এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিন বিএনপির কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তার বিরুদ্ধে নতুন করে আরও তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। সরকারের নির্বাহী আদেশে তাকে আবারও মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নাশকতার এক মামলায় আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারা প্রিজনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।

শুধু মেয়র আবদুল মান্নানই নন, বিএনপির অধিকাংশ মেয়র বা জনপ্রতিনিধির একই অবস্থা। সরকারবিরোধী অন্তত দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন। তারা সবাই সিটি, পৌর ও উপজেলায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধির বড় একটি অংশই এখনো কারাগারে। অনেকেই আবার মামলার হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার একটি অংশ রয়েছেন, যারা স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ‘ম্যানেজ’ করে প্রতিনিধির পদ টিকিয়ে রেখেছেন। তারা বিএনপির কর্মসূচিও এড়িয়ে চলছেন। যারা যোগসাজশ করতে পারছেন না, তাদেরই ঠিকানা হয় জেল নতুবা আত্মগোপনে। 

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়র বা জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করার যে বিধি সরকার প্রয়োগ করছে, এটাকে ‘কালো আইন’ বললে ভুল হবে না। এ বিধি বাতিল করা উচিত। নতুবা সংশোধনী আনা উচিত। কারণ যতক্ষণ না একজন জনপ্রতিনিধি চূড়ান্তভাবে দোষী হবেন, ততক্ষণ তাকে দায়িত্ব থেকে সরানো যাবে না এমন বিধান করা হোক। এ কারণেই জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ আদালতে গেলে স্বপদ ফিরেও পাচ্ছেন তারা।  স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (চার্জশিট আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পর পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে। এ আইনের ধারায় ইতিমধ্যে সারা দেশে ২৩ জন  মেয়র, ২৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৩ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং দেড় শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যদি কেউ সুনির্দিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বরখাস্ত করা অত্যন্ত নিন্দনীয়। মন্ত্রণালয় এককভাবে এটি করতে পারে না। এটি গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায়। জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তার মতে, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তবে কোনো জনপ্রতিনিধি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে যদি বরখাস্ত হন, তাহলে এটা খুবই অন্যায়। ওই স্থানীয় সরকার বিধিকেও অগ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যাদের বরখাস্ত করেছে, তাদের  বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত জোটের জনপ্রতিনিধি। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনবিরোধী এবং বর্তমান আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের যেসব জনপ্রতিনিধি জড়িত ছিলেন, তারাই বরখাস্ত হচ্ছেন। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ২৩৪ পৌরসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহীসহ মাত্র ২৩টিতে জয় পায় বিএনপি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ‘গা’ বাঁচিয়ে চলছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় জেলে রয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ওই মামলার পরপরই তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। একই মামলায় হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ কারাগারে রয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুই সপ্তাহের জামিনে মুক্তিও পান আরিফুল হক। পরে তার জামিন বাতিল করা হয়। রাজশাহী সিটি মেয়র ও নগর যুবদলের আহ্বায়ক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তার বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ রায় হত্যাসহ বিস্ফোরক আইনে ১৬টি মামলা রয়েছে। তিনিও বর্তমানে জেলে রয়েছেন। খুলনা সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিও গত সপ্তাহে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ফৌজদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ার পরপরই তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধেও নাশকতার একাধিক মামলা রয়েছে। মেয়র পদ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন তিনি। তবে এখনো তা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। সূত্রমতে, বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামাল আর কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বিএনপির রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তবে সম্প্রতি বরিশালে বিএনপির নব ঘোষিত কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আহসান হাবিব কামাল। সাংগঠনিকভাবে বড় কোনো পদেও নেই তিনি। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দুর্নীতি মামলা। সারা বছরই ঢাকা-বরিশালে যাওয়া-আসার মধ্যেই থাকেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও সেই অর্থে তার কোনো যোগাযোগ নেই। অন্যদিকে মনিরুল হক সাক্কু ‘ম্যানেজ’ করেই পদ টিকিয়ে রাখছেন বলে কুমিল্লা বিএনপির একাধিক নেতা জানান। দলীয় কর্মসূচিতেও তাকে খুব একটা দেখা যায় না। জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ থাকলেও তা ব্যবহার করেন না সাক্কু। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা সমালোচনাও রয়েছে।

কুমিল্লার বড়ুরা পৌর মেয়র জমিস উদ্দিন পাটোয়ারি। সেখানে জাতীয় পার্টির এমপি থাকায় তার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এমপির সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করছেন। তার বিরুদ্ধে নাশকতার কোনো মামলা নেই। পঞ্চগড়ের মেয়র তৌহিদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধেও নেই কোনো মামলা। আওয়ামী লীগ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক রেখেই মেয়র পদ টিকিয়ে রেখেছেন। বিপুল ভোট পেয়ে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মির্জা ফয়সাল আলিম। নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। সর্বশেষ ডিসেম্বরে রাজশাহীর নওহাটায় শেখ মকবুল হোসেন, তানোরে মিজানুর রহমান, চারঘাটে জাকিরুল ইসলাম বিকুল ও পুঠিয়ায় আসাদুল হক আসাদ পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে জাকিরুল ইসলাম বিকুলের বিরুদ্ধে দুটি নাশকতার মামলা রয়েছে। সবাই ‘গা’ বাঁচিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর বিএনপির তারিক আহমদ নাশকতার মামলায় জামিন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে তোফাজ্জল ইসলাম চৌধুরী, সদরে জিকে গউছ, চুনারুঘাটে নাজিম উদ্দিন শামছু নির্বাচিত হন। এর মধ্যে জিকে গউছ জেলে রয়েছেন। বাকি দুজন পদ টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের কৌশল চালিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বগুড়ার সান্তাহারে তোফাজ্জল হোসেন ভুট্টু, গাবতলীতে সাইফুল ইসলাম ও নন্দীগ্রামে কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল মেয়র নির্বাচিত হন। তোফাজ্জল হোসেন ভুট্টু হত্যা মামলার আসামি। বর্তমানে জামিনে রয়েছেন তিনি। গাবতলীতে সাইফুল ইসলাম মামলার হুলিয়া নিয়েও বিএনপির সব কর্মসূচিতে সরব ভূমিকা পালন করছেন। কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর