শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
দিল্লির চিঠি

বাগাড়ম্বর দিয়ে সত্য চেপে রাখা যায় না

এম জে আকবর

বাগাড়ম্বর দিয়ে সত্য চেপে রাখা যায় না

সরকারি ক্রিয়াকর্মবিষয়ক একটা ইঙ্গিতবাহী শব্দ আছে ‘প্রমাণ হয়নি’। কী করা উচিত বা কী করা হবে তা জানানোর মতো সামর্থ্য নেই, অতএব ‘চেপে যাওয়া হচ্ছে’ বোঝানোর জন্যই ও রকম শব্দ প্রয়োগ। অনেকটা সে ধরনের এক শব্দের আবির্ভাব স্বীকার করতে চলেছে ভারতীয় রাজনীতি। শব্দটি হচ্ছে ‘উত্তর হয়নি’। আকৃতি আর মনোভঙ্গি আড়াল করে রাখার মতলবে জোর গলায় কথা বলে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা আর কি! অথবা ক্রিকেটীয় ভাষায় বলা যায়, স্নিক যদি করবেই খুব জোরেই কর, যাতে স্লিপে ধরা না খেয়ে বল বাউন্ডারিতে গড়ায়।

ইতালীয় একটি আদালত ঘুষ দেওয়ার দায়ে একটি অস্ত্র কোম্পানির নির্বাহীদের সাজা ঘোষণার সময় রায়ে মিসেস সোনিয়া গান্ধীর প্রসঙ্গ টেনেছিল। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সোনিয়া উদ্ধতভাবে বলেন, তিনি কারও ভয়ে ভীত নন। হতে পারে বিলকুল সত্য হতে পারে যে সোনিয়া ভীত নন। কিন্তু তাকে তো ‘আপনি কি ভীত?’ এ রকম প্রশ্ন করা হয়নি।

সত্য তো হতেই পারে যে সোনিয়া আইনের ভয়ে ভীত নন। গেল তিন দশক ধরে কংগ্রেস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যখনই ক্ষমতায় ছিল, তখন তো অন্যরাই সোনিয়ার ভয়ে ভীত ছিলেন। এমনকি তার পার্টি যখন ক্ষমতার বাইরে এবং কিছুটা বিপর্যস্তও, তখনো এই পার্টি পুরোপুরি তার প্রভাবমণ্ডিত হয়ে তাকে দিয়ে রেখেছে অর্ধেশ্বরীর মর্যাদা : তার কোনো ভুল হতে পারে না। এ ধরনের প্রশ্নহীন আনুগত্য আসত্তির রূপ নিতে পারে। দল ও দলীয় নেতার মধ্যকার সম্পর্কে এই শ্রদ্ধা ও ভদ্রতাপূর্ণ ব্যাপার অশোভন নয়। যা মোটেই শোভন নয় তা হলো অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারিতে জড়িত কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক। দেশ জানতে চায়, হেলিকপ্টার কিনতে গিয়ে যে টাকাকড়ি সে দিল, সেগুলোর কী হলো? প্রশ্নের তো ঘাটতি নেই। শুরুতেই ওঠা প্রশ্ন : কেলেঙ্কারিটির বিশদ বিদেশে প্রকাশ হওয়ার পর সিবিআই প্রাথমিক তদন্ত শুরু করল। এর এক দিন পরই ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ ভারত ছেড়ে চলে গেলেন জেমস ক্রিশ্চিয়ান মাইকেল। দিল্লিতে শাসক দলের পরিমণ্ডলে সুপরিচিত মুখ এই মাইকেল হলেন অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড কেলেঙ্কারির মধ্যমণি। তাকে কীভাবে দেশত্যাগ করতে দেওয়া হলো? পরিত্যক্ত পোয়ান হান্স হেলিকপ্টার ‘কেনার জন্য’ অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডের কাছ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ ইউরো (১৩৫ কোটি রুপি) নেন মাইকেল। এ টাকার মাত্র ৫ শতাংশ দিয়েই ওই হেলিকপ্টার কেনা সম্ভব। মাইকেল ওই টাকা কাকে দেওয়ার জন্য নিয়েছিলেন? ইতালীয় আদালতের রায়ে ভারতের অত্যন্ত ক্ষমতাবান একটি পরিবারের কথা বলা হয়েছিল। কোন সেই পরিবার? কংগ্রেস নেতারা উচ্চকণ্ঠে বলেন যে, ঘুষ লেনদেনের খবর ফাঁস হওয়ার পর তারা হেলিকপ্টার চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। খুবই মজার ব্যাপার! চুক্তি বাবদ যে বিপুল টাকা অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডকে দেওয়া হয়েছিল তার কী হলো? সেই টাকা কেন ফেরত এলো না? অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত দিল না, অগ্রিম নেওয়া টাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য হেলিকপ্টারও দিল না। টাকার খেলায় ওদের দুবার জিতিয়ে দিতে হয়েছে কেন? আমরা আরও জানতে পাই, ভারতীয় মিডিয়ার চোখে ঠুলি পরানো কিংবা সম্ভাব্য মিডিয়া ট্রায়াল হলে তাদের পক্ষে গীত গাওয়ানোর জন্য অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড ৫০ কোটি রুপি বরাদ্দ করেছিল। ওটা অবশ্য আরেক নোংরা কাহিনী, যা কৌটা থেকে কিলবিল করে বেরোনোর অপেক্ষায় রয়েছে। বলতে গেলে পুনরুক্তি হবে। তবে এটা বিস্ময়কর কিছু নয় যে, কংগ্রেস নিজ পক্ষ সমর্থনে নানা যুক্তি দেখাবে। ওটা করতে গিয়ে তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। ভুল বলছে অথবা চিল্লাবিল্লা করছে। সংসদে তারা বলেছে, কংগ্রেস সরকার অগস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। না, তা করেনি। মনগড়া অভিযোগও করা হচ্ছে। হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি বিষয়ে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের রফা হয়ে গেছে বলে পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি রাজ্যসভার অধিবেশনে এ মিথ্যাচার তুলে ধরার পর কংগ্রেস অতিরঞ্জনের কাজে ক্ষান্ত দিয়ে নীরবতা অবলম্বন করছে। বাগাড়ম্বর দিয়ে সত্য চেপে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশ পাবেই। ইতালির আদালতে মামলা ওঠায় নাটকীয় কিছু শুরু হতে চলেছে। আমাদের দেশে তদন্ত প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে থাকলে দেশবাসী আরও অনেক কিছু জানতে পাবে। ক্ষমতার যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে সত্য গোপন করার জন্য জাল বোনা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় যতদিন কেবল ততদিনই এ খেলাটা টিকে থাকে। একটা সময় ছিল যখন সিপিআই (এম) ও সিপিআই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করত। এখন, মার্কসবাদীরা আপসকামী। পশ্চিমবঙ্গে তারা মমতা ব্যানার্জির দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব হুঙ্কার দিচ্ছে তাকে ফাঁকা বুলি বলা যায়, কারণ হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারির ব্যাপারে তারা নীরব। মার্কসবাদীরা যদি পাশ্চাত্যের ‘দুর্নীতিপরায়ণ পুঁজিবাদ-শিল্প-সামরিক কমপ্লেক্স’-এর স্বরূপ উন্মোচন করতে না পারে, তাহলে আর কী-ইবা বলা যাবে!

সর্বশেষ খবর