শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

চলছে নিজামীর ফাঁসির প্রস্তুতি

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

মির্জা মেহেদী তমাল ও আহমেদ আল আমীন

চলছে নিজামীর ফাঁসির প্রস্তুতি

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরে আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ। প্রস্তুত এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ। ডাকের অপেক্ষায় রয়েছে পাঁচ সদস্যের জল্লাদের দল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে গতরাতে রায় পড়ে শোনানো হয়েছে। কারা কর্মকর্তাদের কয়েক দফায় বৈঠকও সম্পন্ন হয়েছে। কারাগারের নিরাপত্তায় নেই কোনো ঘাটতি। দুই স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে কারাগার ঘিরে। এখন শুধুই অপেক্ষা। ফাঁসির মঞ্চে কখন নেওয়া হবে কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীকে—এই খবরের অপেক্ষাতেই এখন দেশের মানুষ।

কারা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয়েছে কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ। নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নতুন কারাগারে। তবে কোনো কারণে সেখানে ফাঁসির মঞ্চের সম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন না হলে বেছে নেওয়া হতে পারে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারের ফাঁসির মঞ্চই। তবে কাশিমপুর কারাগার থেকে কেরানীগঞ্জে না নিয়ে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ায় সেখানেই ফাঁসি কার্যকরের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠে। গত রাত সোয়া ৮টায় যোগাযোগ করা হলে একজন কারাকর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফাঁসির রায় কার্যকরের খুব কাছাকাছি রয়েছেন তারা। নিজামীকে রায় শোনানোর পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। তার জবানিতে জবাব শোনার অপেক্ষায় রয়েছি। প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলে সচল হয়ে উঠবে ফাঁসির মঞ্চ। তার আগে নিজামীর পরিবারের সদস্যদের কারাকর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠাবে শেষ সাক্ষাতের জন্য। আর প্রাণভিক্ষা চাইলে তাকে সময় দেওয়া হবে।

তবে নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম গতকাল বলেছেন, গত বৃহস্পতিবার নিজামী তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি কারা কর্তৃপক্ষের রয়েছে। এখন বিধি অনুযায়ীই দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রাণভিক্ষা না চাইলে যে কোনো মুহূর্তেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগই কেবল রয়েছে নিজামীর। তিনি তা না চাইলে দণ্ড কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে কারা কর্তৃপক্ষ। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত আলবদর প্রধান শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের সংবাদ শুনতে উন্মুখ হয়ে আছে দেশের মানুষ। গতকাল দিনভর সাংবাদিকরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন সেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য। ফাঁসির রায় কার্যকর হতে পারে যে কোনো মুহূর্তে— এমন খবরে নিজামীর বনানীর বাসায় তার আ?ত্মীয়স্বজনরা আস?তে শুরু ক?রেছেন। মিশন নাহার নামে সেই বাসায় গতরাতে প্রচুর আত্মীয়স্বজনকে দেখা গেছে।

গত রবিবার রাতে কাশিমপুর কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নিজামীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। তাকে রাখা হয়েছে কনডেম সেল রজনীগন্ধ্যায়। কনডেম সেলে বন্দী শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধী গতকাল ছিলেন বিচলিত। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালনকারী এই মতিউর রহমান নিজামী ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। একাত্তরে ঘাতক সংগঠন আলবদর বাহিনীরও প্রধান ছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় নিজামীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। সেই মামলায় করা আপিল এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন।

রায় প্রকাশ : গতকাল বিকালে বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ২২ পৃষ্ঠার রিভিউ রায়টি প্রকাশিত হয় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটেও। রায়ে বলা হয়, সপ্তম ও অষ্টম অভিযোগে নিজামী দোষী সাব্যস্ত হলেও তার আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি না দিয়ে পরোক্ষভাবে মূলত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় আসামির সম্পৃক্ততা মেনে নিয়েছেন। আবার আসামিপক্ষ দণ্ড কমানোর কথা বলেছে, যদিও আবেদনকারী সেসব অপরাধে সম্পৃক্ততার দায় এড়াতে পারেন না। আদালত এ আবেদনে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাননি। এ কারণে আবেদন খারিজ করা হলো। ২২ পৃষ্ঠার এ রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সংশ্লিষ্ট তিন বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর স্বাক্ষরের পর বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে রায় প্রকাশ করা হয়। ট্রাইব্যুনালে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়। রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল করলে বিষয়টি আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগে নিজামীর আপিল খারিজ হলে তিনি রিভিউ আবেদন করেন। ৫ মে নিজামীর রিভিউ খারিজ করেন আপিল বিভাগ।

রায়ের কপি কেন্দ্রীয় কারাগারে : মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর সাজা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপির অনুলিপি গতকাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৮১২১ নম্বরের একটি গাড়িতে করে রায়ের অনুলিপি নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল। পরে তাদের কাছ থেকে এ রায়ের কপি গ্রহণ করেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর।

আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাঁসির রায় : নিজামীর রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় পাঠানো হয় আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে তা দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। এর আগে সুপ্রিমকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী বিকাল ৫টা ৭ মিনিটে এ রায় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে দেন। একই সঙ্গে রায়টি পাঠানো হয়েছে ঢাকার জেলা প্রশাসকের (ডিস্ট্র্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে। সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে ফাঁসি কার্যকরের আদেশ দেবে কারা কর্তৃপক্ষকে। লিখিত ওই চিঠি পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে নিজামীকে।

কেন্দ্রীয় কারাগারে বাড়তি নিরাপত্তা : র‌্যাব, পুলিশ ও কারারক্ষীদের সমন্বয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের বাইরে দুই স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে এ নিরাপত্তা বলয় দৃশ্যমান হয় বলে স্থানীয়রা জানান। তবে পুলিশ বলছে এটা তাদের নিয়মিত ডিউটির অংশ। পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মফিজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসামি আদালতে নেওয়া এবং আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে প্রবেশ করানোর সময় প্রতিদিনই এমন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। এটা নতুন কিছু নয়।’ এর আগে রবিবার মধ্যরাতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির নিজামীকে এই কারাগারে আনা হয়েছে। এ সময় থেকেই মূলত নাজিমুদ্দিন রোডে অতিরিক্ত পুলিশের আনাগোনা দেখা যায়।

নিজামী প্রাণভিক্ষা না চাইলে যেকোনো সময়ে ফাঁসি : ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে যদি প্রাণভিক্ষা না চান, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরবর্তী সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে যেকোনো সময় তার দণ্ড কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় কারাগার প্রস্তুত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও প্রস্তুত— এখন রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আসলেই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সাধনা সংসদ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিকৃতি রোধে সচেতনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর