বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

টেনশন সরকারি দলকে নিয়েই

মন্ত্রী-এমপিদের অনেকের বেপরোয়া অবস্থানে বিতর্ক বাড়ছে । বাড়াবাড়ি করছে ২০০৯ ও ২০১৪ সালের পর আগতরাহ । ইউপি নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত থেকে যোগদানকারীরা লাগামহীন

নিজস্ব প্রতিবেদক

টেনশন সরকারি দলকে নিয়েই

ঘটনাস্থল কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ। চারদিকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে সামসুল আলম মানিক ও জাহাঙ্গীর আলমের দাপট। কিছুদিন আগেও তারা আওয়ামী লীগে ছিলেন না। বরং প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে নেতা-কর্মীদের বেপরোয়া কুপিয়েছেন এই দুজন। এখন তারাই আওয়ামী লীগের নেতা। হত্যাসহ এক ডজন মামলার আসামি হলেও পুলিশের সামনেই তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একের পর এক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে শাসাচ্ছেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা করছেন পোড়খাওয়া আওয়ামী লীগারদের ওপর। স্থানীয়রা সবাই জানেন, ক্ষমতায় না থাকলে এই দুজন আর আওয়ামী লীগের থাকবেন না। এর পরও তারাই সরকারি দলের নামে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন। অবশ্য এ ঘটনা শুধু মনোহরগঞ্জে নয়। সারা দেশেই নব্য আওয়ামী লীগ নেতারা এমন ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা বাড়াবাড়ি করছেন নানা ক্ষেত্রে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগে আগত বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু মন্ত্রী-এমপির বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। তাদের কারণে তৈরি হচ্ছে বিতর্ক। রাজনৈতিক কোনো ইস্যু না থাকলেও অহেতুক ইস্যু তৈরি করছেন এই নেতারা। ফলে সরকারকে টেনশনে পড়তে হচ্ছে নিজ দলকে নিয়েই। আওয়ামী লীগের নেতৃমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সুবিধাভোগীরা বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। এর পেছনে হচ্ছে অর্থের লেনদেন। সেটি হচ্ছে দলের নানা স্তরে। উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেই কেউ কেউ সুযোগ করে দিচ্ছেন একসময় বিএনপি-জামায়াতের নামে দাপট দেখানো বিতর্কিত ব্যক্তিদের। সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা জামায়াতের চিহ্নিত নেতা-কর্মীদের দলে অন্তর্ভুক্তিতে একাধিক মন্ত্রী-এমপি প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে দলে নিয়ে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন, কেউ দিচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন। তবে সবই নির্ভর করছে টাকার পরিমাণের ওপর। জেলার মন্ত্রী-এমপি, প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ও তাদের কাছের লোকজনকে ম্যানেজ করেই যোগ দেওয়া যাচ্ছে সরকারি দলে, পাওয়া যাচ্ছে মনোনয়ন। শুধু আর্থিক লেনদেনের কারণেই যুদ্ধাপরাধে জড়িত ব্যক্তি, রাজাকারের সন্তান ও জামায়াত নেতারা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছেন। এ কারণে লন্ডনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সার্বক্ষণিক সাহচর্যে থাকা ব্যক্তির সিলেটে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এদের কেউ কেউ এখন পৌরসভা মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি দলীয় মনোনয়নে এমপিও হয়েছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ২০১৫ সালের প্রথম দুই মাস পর্যন্ত দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দেন অন্য দলের নেতা-কর্মীরা। কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তরাও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করে স্থান পায় আওয়ামী লীগে। বিএনপি-জামায়াতের বছরব্যাপী অবরোধ কর্মসূচিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ডজনখানেক মামলার আসামিও এখন আওয়ামী লীগ নেতা। টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এই নেতারা এখন দলীয় কোনো আনুগত্যই মানছেন না। স্থানীয় টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে যত্রযত্র দখল ও চাঁদা আদায়ই তাদের মূল কাজ হয়ে উঠেছে। উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, ‘বেশির ভাগ সময় রাজধানীতে থাকা এমপিদের দেখাই পান না তৃণমূলের কর্মীরা। তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয় রাজধানীতে। ভাগ্য ভালো হলে তিন দিন জুতার তলা খসিয়ে পাওয়া যায় সাক্ষাৎ। কিন্তু তারাই যখন বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ফুলের মালা গলায় পরাতে নিজের দামি গাড়িতে চড়ে এলাকায় আসেন, তখন চোখের পানি ধরে রাখা যায় না।’ অন্যদিকে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরাও বিভিন্ন সময় অহেতুক বিতর্কিত ইস্যু তৈরি করে সরকারকে টেনশনে ফেলছেন। একসময় জামায়াত নেতা থেকে এখন আওয়ামী লীগের এমপি হওয়া এক নেতা সম্প্রতি নিজের ছবির মাথা কেটে বঙ্গবন্ধুর ছবি বানিয়ে তৈরি করেন বিতর্ক। অহেতুক ইস্যু তৈরি করেছেন একাধিক মন্ত্রীও। দলের বিভিন্ন কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর জেলা ও মহানগর কমিটির বিভিন্ন পদ বিক্রির কথা প্রকাশ্যেই শোনা যায়। আর মূল দলের সহ-সম্পাদক পদের বিষয়ে তো কথার শেষই নেই। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল দেশকে একটি উন্নত অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। বর্তমান পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী দুই-তিন বছরে এ দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে। এমন সময়ে দলে অনুপ্রবেশ করা ব্যক্তিদের দ্বারা বিতর্ক সৃষ্ট হওয়া কাম্য নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক, আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলে কিছু সুবিধাভোগী ঢুকে যেতে পারে। তবে সাবধান থাকতে হবে, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় না পায়। তাই দলীয় কারও বিরুদ্ধে যেখানেই অভিযোগ উঠুক, আইনের শাসন নিশ্চিতে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতেই হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর