বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

বায়বীয় ভাবনাচিন্তা

সমরেশ মজুমদার

বায়বীয় ভাবনাচিন্তা

‘কালবেলা’ লেখার সময় মনে আসেনি, পরে একজন হিতৈষী বলেছিলেন, ‘উপন্যাসটি খুব ভালো কিন্তু বিক্রি হবে না।

নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছেন আপনি।’ আমাকে অবাক হতে দেখে বলেছিলেন, ‘আরে মশাই, আমরা হলাম বাঙালি, ইংরেজ বা আফ্রিকান নই। একটা কুমারী মেয়ে মানে ওই মাধবীলতা, অনিমেষের প্রেমে পড়ল। ওদের শারীরিক সম্পর্ক হলো, এই অবধি ঠিক ছিল, ওকে    মাতৃত্ব দিলেন কেন? বিয়ে না করে অবৈধ মা হয়ে গেল সে! বিদেশে হতে পারে, এ দেশের মহিলারা অ্যাকসেপ্ট করবে? আর বই যারা কেনেন? তারাই তো লঘিষ্ঠ ক্রেতা। আপনার এই বই কেউ কিনবে না।’ ভেবেছিলাম, কী আর হবে! যা ঠিক মনে করেছি তাই লিখেছি। পাঠক যদি বই না কেনে তাহলে আমার কিছু করার নেই। কোন বই পাঠক কিনবেন বা কিনবেন না তিনিই তা স্থির করে থাকেন, লেখক তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করতে পারেন না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, বিক্রি হতে লাগল। খবরের কাগজের সীমা অনুযায়ী পশ্চিম বাংলার মূল প্রকাশক দেড় লাখ কপির বেশি বিক্রি করেছেন। বাংলাদেশের প্রকাশক, যিনি অনুমতি নিয়ে ছেপেছেন, তাকে লড়াই করতে হয়েছে পাইরেট বইয়ের প্রকাশকদের সঙ্গে। তাই ওখানকার বিক্রির সংখ্যা অনুমান করা যায় কিন্তু সঠিক নয়। বইটি বের হওয়ার বছর তিনেক বাদে ঢাকায় গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ টিভির দুজন মহিলা ও পুরুষ সাংবাদিক, এসেছিলেন আলাপ করতে। মহিলা বললেন, ‘আমার নাম মাধবীলতা।’ পুরুষ সাংবাদিক জানালেন, তার নাম অনিমেষ। বুঝলাম আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন। কিন্তু তারা তাদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখালেন যেখানে এই নামগুলোই লেখা রয়েছে। আমি হতভম্ব। শুনলাম, চরিত্র দুটোর প্রেমে পড়ে ওরা আদালতে গিয়ে নতুন নাম আইনসম্মত করে নিয়েছেন। তখনই খেয়াল হতে প্রশ্ন করেছিলাম, মাধবীলতা কিন্তু কুমারী মা, কী করে মানলেন? মহিলা হাসলেন ‘হু কেয়ার্স’! মনে বল পেলাম। যে যাই বলুক আমি ঠিক থাকলেই হলো। কিন্তু মাস তিনেক আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে গিয়ে আবার একই সমস্যার মুখোমুখি হলাম। ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করছিল বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ে, উত্তর দিচ্ছিলাম। একটি মেয়ে, বছর একুশের, অনেকক্ষণ হাত তুলেছিল প্রশ্ন করার সুযোগ পেতে। হেসে বললাম, ‘বলো ভাই’। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। জিন্স আর রঙিন গেঞ্জি পরা সুন্দরী মেয়েটি বলল, ‘আমি আপনাকে দুটো প্রশ্ন করতে চাই।’ ‘বল’। মাধবীলতা যদি আপনার মেয়ে হতো তাহলে কি তাকে আপনি সমর্থন করতেন? আপনার মেয়ে কুমারী অবস্থায় মা হলে তাকে কি অ্যাকসেপ্ট করতেন?’ সরাসরি জিজ্ঞাসা করল মেয়েটি। হলঘরে তখন একটা পিন পড়লে শব্দটা শোনা যেত। আমার মেয়ের মুখ মনে হলো। ও যদি এমন করে তাহলে আমি কি মেনে নেব? আমার উপন্যাসের নায়িকা যা করতে পেরেছে, পেরে জনসমর্থন পেয়েছে, লাখ লাখ কপি বইটি বিক্রি হয়েছে তা ব্যক্তিগত জীবনে ঘটলে আমি কি মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব? হঠাৎ হলঘরে বসে থাকা অন্য ছেলেমেয়েরা এমন চেঁচামেচি শুরু করল যে মেয়েটি বসে পড়তে বাধ্য হলো। একজন অধ্যাপক ঘোষণা করলেন, ‘কেউ কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবে না।’ আমি তখনকার মতো রক্ষা পেলেও প্রশ্নটা এখনো মনে পাক খেয়ে চলেছে। গত সোমবার আমার এক অধ্যাপক বন্ধু ফোন করেছিলেন। সল্টলেকে তার বাড়ি। দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে থাকেন। বললেন, ‘দাদা একটু সমস্যা হয়েছে।’ ‘যেমন’? ‘আমার একটা ফ্ল্যাট খালি হওয়ায় নতুন ভাড়াটে খুঁজছিলাম। পেয়েছি। ছেলেটি ইন্সপেকশন টেকনোলজিতে ভালো মাইনে পায়। মেয়েটিও তাই।’

‘তাহলে সমস্যা কিসের?’ ‘আরে ওরা বিয়েই করেনি। লিভটুগেদার করবে। আর কথাটা পরিষ্কার বলল। কোনো সংকোচ করল না। অধ্যাপক একটু উত্তেজিত, ‘ওরা যদি বিবাহিত হতো তাতে কী সুবিধে পেতেন?’ ‘মানে’? ‘আপনার দরকার একটি ভদ্র ভাড়াটে যে ঠিক সময়ে ভাড়া দেবে। তাই তো?’ ‘আমি! বিয়ে না করে থাকবে এটা মেনে নেওয়া যায়?’ ‘আইন মেনে নিয়েছে। জানেন তো।’ ‘তা জানি।’ কিন্তু ধরুন, আপনার ছেলে বা মেয়ে এদের মতো কেউ টুগেদার করতে চাইত, আপনি মেনে নিতেন? ‘বিয়ের পর ডিভোর্স করার চেয়ে এটাকেই প্রেফার করতাম। লিভটুগেদারে যদি মতান্তর হয় তাহলে তো কোর্টে যাওয়ার দরকার হয় না।’ ‘আচ্ছা, যদি ওদের বাচ্চা হয়ে যায়?’ ‘আপনার মেয়ের তো বছর আটেক আগে বিয়ে হয়েছে। সে কি শারীরিক অসুবিধের কারণে এখনো মা হতে পারেনি?’ ‘না না। আর বলবেন না, ওরা বাচ্চার ঝামেলা নিতে চাইছে না।’ তাহলে দেখুন বিবাহিত হয়েও যদি আপনার মেয়ে মা না হতে চায় তাহলে এরা কেন চাইবে? মেয়েটি তো নিজের নিরাপত্তা দেখল।’ ‘ও’ তাহলে ওদের ভাড়া দিয়ে দিই, কি বলেন।’ এখনো এসব সমস্যা আমাদের বিব্রত করছে। আমাদের বাবা ঠাকুরদা যা মানতেই পারতেন না তার অনেকটা মেনে নিতে হলো। আমরা যেখানে আটকে আছি, আমাদের পরের প্রজন্ম তা হাস্যকর মনে করবে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সমাজবন্ধন থেকে বায়বীয় ভাবনা শেষ হওয়ার দিন এই হলো বলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর