শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে

অনিয়মের শীর্ষে সেবাখাতগুলো । মাঠে নেমেছে দুদক । হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তদন্ত । চলছে গ্রেফতার অভিযান

নিজামুল হক বিপুল ও মোস্তফা কাজল

উৎকণ্ঠা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে

রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকার তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু রূপালী ব্যাংকই নয়, আর্থিক ও সেবা খাতের সব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে দুদক। পর্যায়ক্রমে সব খাতেরই অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করবে প্রতিষ্ঠানটি। সেবা খাতগুলোর বর্তমান অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। টাকা ছাড়া সেবা খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সেবা পাওয়া যায় না। সেগুলোয় মানুষ দিনের পর দিন হয়রানির শিকার। অনিয়মই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় সেবা খাতগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে খোদ সরকারপ্রধানই দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন ওসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারপ্রধানের নির্দেশনার পর দুদক এখন ব্যস্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করতে। দুদকের কর্মকর্তারা প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের জন্য। এরই অংশ হিসেবে গত কয়েক দিনে সারা দেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত দেড়শ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠান ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, রাজউকের কর্মকর্তা। আছেন সিভিল সার্জনও।

দুদক সূত্র জানায়, গত ১৫ মার্চ ইকবাল মাহমুদ দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর দৃশ্যমান তৎপরতা বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তারপরই মূলত দুদকের বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়। জানা গেছে, দেশের সরকারি সেবা খাতগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। এ বিষয়টি সরকারপ্রধান পর্যন্ত অবগত। মানুষ সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে বার বার হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। অনেক সময় টাকা দেওয়ার পরও কাজ হয় না। বাড়ে শুধু ভোগান্তি। সরকারি ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে, যা আর ফেরত আসছে না। অনিয়মের দিক থেকে পিছিয়ে নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও। তবে সরকারের সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে সারা দেশের ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, চিকিৎসা খাত, রাজউক, প্রকৌশল খাত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়।

সাম্প্রতিক সময়ে এর অনেক নজিরও দেখা গেছে। চুয়াডাঙ্গা ও গাইবান্ধায় কৃষি অফিস ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় সরকারি প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় ভবনের ছাদ নির্মাণের ক্ষেত্রে রডের পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার করেন ঠিকাদার। শুধু স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ঠিকাদার বড় ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেন। একইভাবে ভূমি অফিসগুলোয় কোনো কাজে গেলেই চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে জোতদার-বিত্তশালী কেউই বাদ যান না মাঠপর্যায়ের ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে। টাকা দিলেই সব কিছু নিয়মে পরিণত করে দেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

সেবা খাতের মধ্যে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাহিনী বেশি শোনা যায়। ভবন নির্মাণের জন্য ত্রুটিপূর্ণ নকশা সহজেই অনুমোদন দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। আবার ৬ তলা অনুমোদন দিয়ে কেউ ৮ থেকে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করলেও অবৈধ অর্থের বিনিময়ে তা জায়েজ করে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একইভাবে পাসপোর্ট অধিদফতর, তিতাস, ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন সব জায়গায়ই দুর্নীতি ও অনিয়ম জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। পিছিয়ে নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতেও অর্থের বিনিময়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে ফেলা হয় বলে অভিযোগ আছে। সূত্র জানায়, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধেই অভিযানে নেমেছে দুদক। এর অংশ হিসেবেই গত কয়েক দিনে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৫০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এর মধ্যে রয়েছেন— শরীয়তপুর ও সাতক্ষীরা সদরের সাব-রেজিস্ট্রারসহ তিনজন, রাজউকের দুজন পরিদর্শক, ওয়াসার একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন সাবেক এডিজি। আছেন কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনসহ তিনজন চিকিৎসক। দুদক গ্রেফতার করেছে পল্লী বিদ্যুতের একজন মিটার রিডারকে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবিএলের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও আল-আরাফা ইসলামিক কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাবেক একজন পরিচালককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এর বাইরে আরও অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলা হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে দুদকের এই সাম্প্রতিক অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো আসামিকে গ্রেফতারের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তদন্ত কর্মকর্তার। তিনি প্রয়োজনে যে কোনো মামলার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। সম্পদ জব্দ করতে পারবেন। আসামিকে গ্রেফতারসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। তিনি বলেন, অনেক সময় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গ্রেফতার করতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, দুদকের কাছে সব আসামিই সমান অপরাধী। এদিকে সাম্প্রতিক অভিযানের পাশাপাশি দুদক পুরনো ৪০ মামলার পুনর্তদন্তে নামছে বলে জানা গেছে। আগে এসব মামলা যথাযথভাবে তদন্ত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতেই পুনর্তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এজন্য ওই মামলাগুলো ফেরত আনতে আদালতে আবেদন করছে দুদক। এর বাইরে নিষ্পত্তিকৃত অথচ আলোচিত কিছু অভিযোগও পুনঃঅনুসন্ধান শুরু করেছে কমিশন। যার মধ্যে খাদ্য অধিদফতরে ৪৩ কর্মকর্তা নিয়োগ দুর্নীতি মামলাটিও রয়েছে। আছে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান কর্তৃক নিয়োগ দুর্নীতি মামলাটিও। কমিশন মনে করছে, মামলাগুলো পুনর্তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর