বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গতা পায়নি ছয় বছরেও

খসড়া নীতি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণ নোট গাইড-কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জোর সুপারিশ

মাহমুদ আজহার ও আকতারুজ্জামান রুনকি

ছয় বছরেও পূর্ণতা পায়নি জাতীয় শিক্ষানীতি। যুগোপযোগী ও সমন্বিত শিক্ষার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ৩১  মে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে কচ্ছপ গতিতে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষানীতির কাজ যেভাবে চলছে তাতে এক যুগেও পূর্ণতা পাবে কিনা সন্দেহ। মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৮ সালের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষানীতিতে নোট গাইড, কোচিং বন্ধসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শিক্ষক বদল ও পদোন্নতির বিষয়টিও নীতিতে আনা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু গত ছয় বছরে এর কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারসহ শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদদের উপস্থিতিতে গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের    সভাকক্ষে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করলে এ পর্যন্ত অনেক দূর এগোনো যেত। কিন্তু আমাদের শিক্ষানীতি মাত্র বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে। লেইট ইজ বেটার দ্যান নেভার।’ ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। চার মাসের মধ্যে একটি খসড়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে কমিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। মন্ত্রণালয় সর্বজনগ্রাহ্য শিক্ষানীতি প্রণয়নের স্বার্থে সর্বস্তরের মানুষের জনমত গ্রহণ করতে ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করে। সর্বস্তরের মানুষের সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষানীতিতে আরও সংশোধন-সংযোজন করা হয়। জানা যায়, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন-২০১৬ করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে গত এপ্রিল মাসের শুরুতে খসড়া শিক্ষানীতি ওয়েবসাইটে দিয়ে মতামত দেওয়ার জন্য ৭ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। আইনটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আইনটি চূড়ান্ত হলেই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। এর পরই তা আইন হিসেবে গণ্য হবে।

প্রস্তাবিত আইনে যা আছে : প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন-২০১৬ এর নিরক্ষরতা দূরীকরণ, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা এবং একই পদ্ধতির সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধান প্রণয়নকল্পে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনে বিভিন্ন উপধারা সংবলিত ৬৭টি ধারা রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো আইনের আওতায় আনা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আইনে শিক্ষার স্তর হবে চারটি। এগুলো হলো— প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর বয়স হবে চার থেকে ছয় বছর। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হবে ছয় বছর বয়স থেকে। এ স্তর হবে প্রথম  থেকে অষ্টম  শ্রেণি পর্যন্ত। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি হবে মাধ্যমিক স্তর। এরপর শুরু হবে উচ্চশিক্ষার স্তর। তবে অষ্টম  শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষার বিধান থাকলেও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে নির্বাহী আদেশ দিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত জানাবে। প্রস্তাবিত আইনে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে দাখিল ও আলিম পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ পরিচিতি এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়সমূহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। খসড়া শিক্ষা আইনের ৭ এর ২, ৩, ১১ ও ১২ নম্বর উপধারায় বর্ণিত নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এনসিটিবির অনুমোদন ছাড়া কোনো স্কুল বা মাদ্রাসায় কোনো পাঠ্যবই পড়ানোর সুযোগ থাকল না। খসড়া আইনে শিক্ষার্থীদের মানসিক নির্যাতন ও শারীরিক শাস্তি দিলে অনধিক ১০ হাজার টাকা অথবা তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনা করা যাবে না। জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান, অনগ্রসরতা, দূরত্ব বিবেচনায় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এই বিধান লঙ্ঘন করলে মাধ্যমিক স্তরের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা ও ছয় মাস কারাদণ্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে। খসড়া আইন অনুসারে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী বদলি ও পদোন্নতির সুযোগ পাবেন।

অনুমোদনহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা শাখা ক্যাম্পাস, স্টাডি সেন্টার বা টিউটোরিয়াল কেন্দ্রের জন্য ৫ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে খসড়ায়। এ ছাড়া কলেজ পর্যায়ে অনুমতি ছাড়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা ৫ বছর জেল বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৭৩ সালে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। এরপর আরও ছয়টি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠন করা হলেও ২০০০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ছাড়া কোনো শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়নি। বর্তমান সরকার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৭ সালে শিক্ষানীতি রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। এর আলোকে প্রণয়ন করা হয় শিক্ষানীতি ২০০০। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ২০০১ সালের পর সেটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, একটি দেশের জাতীয় শিক্ষানীতি সে দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মূলভিত্তি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রধান সোপান। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শিক্ষা। শুধু তাই নয়, জনগণকে তার সর্বোচ্চ ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপিত করবে এ শিক্ষা ব্যবস্থা। মূলত, শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে গোটা জাতীয় কাঠামো। তাই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে জাতির ভবিষ্যৎ। এ নীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা গেলে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল আমাদের। এ জন্য সব স্কুল-কলেজকে এর আওতায় আনতে কাঠামোগত বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে এ নীতি বাস্তবায়নের কথা। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে পারব। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন আগে শুরু হলে ভালো হতো। তবে পরে হওয়াকেও সাধুবাদ জানাই।’

ইসলামী দলগুলোর প্রতিবাদ : ২০১০ সালের শিক্ষানীতির প্রতিবাদ জানিয়ে তা বাতিলের দাবি করছে ইসলামী দলগুলো। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইন-২০১৬ ওয়েবসাইটে দেওয়ার পর থেকেই তারা এ দাবি জানাচ্ছে। সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই। তিনি বলেছেন, দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত করে কোনো শিক্ষানীতি ও শিক্ষা আইন হতে পারে না।

সর্বশেষ খবর