শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

নাম ছিল তার ‘না’ নগর

সামিয়া রহমান

নাম ছিল তার ‘না’ নগর

সে এক নগর ছিল। নাম ছিল তার ‘না’ নগর। ‘না’ নগর ছিল ধুলাধূসরিত, মলিন।

মলিনতা শুধু রাস্তাঘাট, খাল-বিল, নদী-নালাতেই ছিল না; ধুলা জমেছিল মেলা এই নগরের বাসিন্দাদের মনেও। তাই তো ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করানো, প্রকাশ্যে চাপাতির কোপ ছিল নগরের প্রজাদের বাম হাতের খেলা। কত না চুরি, কত না মৃত্যু হয় এই নগরে। বিচার হয় না। এই নগরে ভালোবাসার গল্প ছিল নিষিদ্ধ। ডজন ডজন প্রেম হতো, লুকিয়ে চুরিয়ে। নিষিদ্ধ প্রেম, পতিতালয়ে যাওয়া— সবই হতো। লুকিয়ে। চৌদ্দ জনের সঙ্গে ফ্লার্ট? তা তো অবশ্যই হতো? সেটা তো সামাজিকতা!!! আবার প্রেম তো একজনের সঙ্গে নয়। গোপনে গোপনে চলত অনেক রকম খেলা। দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে খুন শুধু এই দেশে করা যায়, ভালোবাসা নয়। ‘না’ নগর আবার আধুনিক ডিজিটাল। কিন্তু মননে-মানসিকতায় তারা চরম গোঁড়া। নগর জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আইনের বালাই না থাকলেও গোঁড়ামি পালনে তারা ভীষণ কঠোর। ‘না’ নগরে ফেসবুকের রমরমা বাণিজ্য। সবাই মহাজ্ঞানী-মহাপণ্ডিত, সবাই উপদেশদাতা। একবার এ নগরেরই একটি বোকা ছেলের ভালো লেগে গেল তার মেয়েবন্ধুকে। প্রথম ভালোবাসা, অস্থির উত্তাল আবেগ। ছেলেটি জানে না কী করে প্রকাশ করবে সে তার ভালোবাসাকে। বোকা ছেলেটি চেয়েছিল, তার প্রথম ভালোবাসায় অনেক রোমান্টিকতা, একটু নাটকীয়তা, প্রচণ্ড আবেগ দিয়ে প্রকাশ করবে মেয়েটির কাছে। শেষে উপায় না পেয়ে বন্ধুদের কাছে ধরনা দিল। বোকা ছেলের বন্ধুরা তো মহাবোকা। তারা কি আর জানে এই নগরের ফেসবুকে খুনের ছবি দেওয়া যায়, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারার দৃশ্য মানুষ উপভোগ করে, তাতে লাইকও পাওয়া যায়। নাস্তিকতা-আস্তিকতার বোল তুলে বাহ্বাও পাওয়া যায়। কিন্তু ভালোবাসার ছবি? অসম্ভব! ভালোবেসে জড়িয়ে ধরা সে তো আরও মহাপাপ। সেই মহাপাপেই শাস্তি হলো ‘না’ নগরের এগারোটি ছেলেমেয়ের। তারা ভালোবাসে, ভালোবাসায় হাত মেলায়। তারা প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু তাদের প্রাপ্তবয়স্কের সার্টিফিকেটও তাদের অপরাধ ঘোচাতে পারল না। শুধু ভালোবাসার দোষে শিক্ষালয় থেকেই বহিষ্কৃত হলো তারা। যাক, শিক্ষা না পাক, কুল তো বাঁচল। একটা গল্প মনে পড়ে গেল। একদিন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বাজার থেকে গরুর কলিজা কিনে বাসায় যাচ্ছিলেন। দোকানদার একটা কাগজে তাকে কলিজা ভুনা করার পদ্ধতি লিখে দিয়েছিলেন, যাতে বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারেন। হঠাৎ একটি বাজপাখি উড়ে এসে কলিজার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল। এ সময় হোজ্জা চেঁচিয়ে বললেন, ‘আরে বোকা! কলিজা নিয়ে গেলে কী হবে? প্রস্তুতপ্রণালি তো আমার কাছে।’ আমাদের অতিনৈতিক শিক্ষাগুরুরা বোধহয় এমনটি ভেবেছেন। এই এগারোটি ছেলেমেয়ের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী হবে, শিক্ষালয়ের মান তো বাঁচল! নাসিরুদ্দিন হোজ্জার আরেকটি গল্প বলি। একদিন হোজ্জা তার কাজের ছেলেকে কলসি দিয়ে পাঠালেন কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে। গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললেন, ‘খবরদার! কলসিটা ভাঙিস না যেন।’ একজন সেটা দেখে প্রশ্ন করল, ‘মোল্লা সাহেব! কলসি তো ভাঙেনি। শুধু শুধু চড় মারলেন কেন?’ হোজ্জা বললেন, ‘ভাঙার পর চড় মারলে লাভ কী? তাতে কি কলসি জোড়া লাগবে? আগেই মারলাম যেন না ভাঙে।’ আমাদের নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ এতই ঠুনকো যে আধুনিক টগবগে তরুণদের আবেগ-উচ্ছ্বাসেও তা ক্ষণিকেই ভেঙে পড়ে। তাই বোধহয় নীতিবাগীশ সমাজপতিরা আগে থেকেই তাদের গালে সপাটে চড় কষিয়ে দেন। আমি ‘না’ নগরের বাসিন্দা হতে চাই না। চাই না আমার সন্তানরা এই গোঁড়া, কূপমণ্ডূক সমাজে ভালোবাসাহীন হয়ে বাঁচুক। চাই না গোঁড়ামির জালে নিজেদের গুটিয়ে বিশ্বকে, সমাজকে সংকীর্ণভাবে দেখতে। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। প্রতিদিন খুন, জখম, রাহাজানি, নিষ্ঠুরতা, নোংরামি দেখে দেখে আমি ভীষণ ক্লান্ত। হঠাৎ ফেসবুকে মিষ্টি প্রেমের ছবি দেখে মনে হয়েছিল এখনো তাহলে পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে, স্বপ্ন আছে, আবেগ আছে, মনুষ্যত্ব আছে। কমার্শিয়াল ভালোবাসা দিবসের ব্যবসা বাদে এখনো ছেলেমেয়েরা সত্যিকারের প্রেমে পড়ে। তারা প্রেমে কাঁদে, হাসে, আনন্দিত হয়। আমি একটিও নোংরা কমেন্ট এই ভিডিওতে দেখিনি। অথচ হায় কী দুঃখ! আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাগুরুদের কাছে তাই হয়ে উঠেছে অমার্জনীয় অপরাধ। তাদের পাপ কী ছিল? তারা ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে! ভালোবাসা কি শৃঙ্খলাভঙ্গ? খুব জানতে ইচ্ছা করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিবুদ্ধিমান অধ্যক্ষ, প্রাধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ যে বা যারাই হোন না কেন, তারা কি জীবনে ভালোবাসেননি? তাদের অতীত যদি আজ গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়! ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন নীতিমালায় লেখা আছে অত্র কলেজ বিদ্যালয়ে কেউ ভালোবাসতে পারবে না? কী অদ্ভুত নিয়ম! কী অদ্ভুত তার বাস্তবায়ন! মনে বড় প্রশ্ন জাগে, আমরা জ্ঞানী নির্বোধ, না নির্বোধ জ্ঞানী? নাসিরুদ্দিন হোজ্জার আরেকটি গল্প দিয়েই আজ শেষ করছি। শিকারে বেরিয়েছেন রাজা। যাত্রাপথে প্রথমেই পড়ে গেলেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সামনে। রাজা খেপে গেলেন। পাইক-পেয়াদাদের ডেকে বললেন, ‘হোজ্জা একটা অপদার্থ। যাত্রাপথে ওকে দেখলাম, আজ নির্ঘাত আমার শিকার পণ্ড। ওকে চাবুক মেরে দূর করে দাও।’ রাজার হুকুম তামিল হলো। কিন্তু সেদিন রাজার শিকারও জমে উঠল বেশ। গুনে গুনে ছাব্বিশটি নাদুসনুদুস হরিণ মারলেন তিনি। প্রাসাদে ফিরে রাজা অনুতপ্ত হয়ে ডেকে পাঠালেন হোজ্জাকে। হোজ্জা দরবারে আসতেই রাজা বললেন, ‘কিছু মনে করো না, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি অপয়া, অপদার্থ। আমার শিকার জুটবে না। কিন্তু এখন দেখছি আমার ধারণা উল্টো।’ হোজ্জা খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘রাজা! আপনি আমাকে অপয়া ভেবেছিলেন। অথচ দেখুন, আমাকে দেখার পর আপনি ছাব্বিশটি হরিণ পেলেন, আর আপনাকে দেখে আমি খেলাম বিশ ঘা চাবুক। তাহলে অপয়া যে কে, তা বুঝতে পেরেছেন তো?’ লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর