রবিবার, ২২ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

রোয়ানুর আঘাত উপকূলে

নিহত ২৪, ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বিমানবন্দর বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রোয়ানুর আঘাত উপকূলে

কক্সবাজারে পানিবন্দি মানুষ খুঁজছে নিরাপদ আশ্রয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে গতকাল দুপুরে উপকূলে আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার বিস্তৃত অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পাঁচজনসহ বারোজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়ের সময় দেয়াল ধস ও গাছ চাপা পড়ে উপকূলীয় বিভিন্ন স্থানে মোট ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক জেলেসহ উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত ৭০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের     কবলে পড়েছেন অসংখ্য জেলে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সব ধরনের কার্যক্রম গতকাল দিনভর বন্ধ রাখা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মোহাম্মদ শাহ কামালসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল দিনভর মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত থেকে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি তদারকি করেন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও বাঁশখালী উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে কুতুবদিয়ার চারটি, মহেশখালীর তিনটি, টেকনাফের একটি, পেকুয়ার তিনটি ইউনিয়ন লণ্ডভণ্ড হয়েছে। কক্সবাজারে বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। বরগুনায় দেড় লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া লোকজন নিজেদের ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় আজও বৃষ্টি হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড চট্টগ্রামের পতেঙ্গা

চট্টগ্রামে নিহত ১২ : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে চট্টগ্রামের দুটি উপজেলা ও নগরীতে মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে বাঁশখালী উপজেলায় সাতজন, সীতাকুণ্ডে দুজন ও নগরীতে দুজনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে সীতাকুণ্ডে গাছ পড়ে মারা গেছেন কাজল বেগম (৫০) ও তার শিশু সন্তান বেলাল প্রকাশ আবু (১০)। বাঁশখালীতে মহিলা ও শিশুসহ সাতজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পানিতে ভেসে মারা গেছেন। তারা হচ্ছেন খানখানাবাদের আবু সিদ্দিক (৬০), বুলু আকতার (৩৫), মোহাম্মদ জালাল (৩), মোহাম্মদ রাশেদ (৪), শাহেদা আক্তার (৩) ও তার দেড় মাস বয়সী এক ভাই (নাম জানা যায়নি)। এ ছাড়া ছনুয়াতে মারা গেছেন তাহেরা বেগম (৩৫)। ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় জেলেদের মাছ ধরার সহস্রাধিক নৌকা-সাম্পান ডুবে গেছে। বাঁশখালীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের একটানা গতিবেগ ছিল ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। ঝড়ের সময় গাছ ভেঙে পড়ে সীতাকুণ্ডে মা-ছেলে এবং নগরীর পাঁচলাইশে আম কুড়াতে গিয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বাঁশখালী উপজেলায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে খানখানাবাদ ইউনিয়নে চারজন এবং ছনুয়া ইউনিয়নে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দমকা হাওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়েছে সীমানাপ্রাচীর। উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১০ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ও জুঁইদণ্ডী ইউনিয়ন, বাঁশখালীর প্রেমাসিয়া, খুঁটাখালী জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিকে বাঁশখালীর ওসি আলমগীর হোসেন জানান, জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে খানখানাবাদ ইউনিয়নে দুটি বাচ্চা, এক নারী ও এক বৃদ্ধসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ছনুয়া ইউনিয়নে জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ।

বন্দর ও বিমানবন্দর বন্ধ : ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ মোকাবিলায় চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বন্দরের সব গেট বন্ধ করে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বন্দর জেটি থেকে ১৯টি জাহাজ গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সকাল থেকেই বন্ধ ছিল শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করলেও গতকাল আর বিমান ওঠানামা করেনি। আজ সকাল থেকে সব বিমান নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী ওঠানামা করবে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে বন্ধ ঘোষণার আগেই আন্তর্জাতিক রুটের পাঁচটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর ত্যাগ করে। এদিকে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘বাংলার শিখা’ জাহাজটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে।

কুতুবদিয়ায় নিহত ৩, ২০ গ্রাম প্লাবিত : ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল, কৈয়ারবিল, লেমশিখালি, মহেশখালী উপজেলার মাতাবাড়ি, ধলঘাটা, কুতুবজুম, টেকনাফের সবরাং, সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ, পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়াসহ ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে শতাধিক ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘের, শুঁটকি মহাল বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে গাছপালা। এদিকে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে কুতুবদিয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

ফেনীর সোনাগাজীতে নিহত ১ : ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে একজন নিহত হয়েছে। সোনাগাজীর তিন ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার তিন হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফা হক জানান, চরচান্দিয়া ইউনিয়নে রোয়ানুর আঘাতে হিরণ নামে এক রাখাল নিহত হয়েছে। চারজন নিখোঁজ রয়েছে।

ভোলার তজুমদ্দিনে নিহত ৩ : ঘূর্ণিঝড়ে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শশীগঞ্জ বাজারের শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এ সময় ঘর চাপা পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আকরাম ও রেখা (৩৫) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া দৌলতখান উপজেলায় রেণু বেগম (৫০) নামের এক মহিলা মারা গেছেন। আহত হয়েছে অন্তত শতাধিক লোক। এদিকে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা এলাকার মেঘনা নদীতে বালুভর্তি একটি কার্গো জাহাজ ডুবিতে চারজন নিখোঁজ রয়েছে বলে ভোলা থানার ওসি খায়রুল কবির নিশ্চিত করেছেন। ভোলা-তজুমদ্দিন-চরফ্যাশন সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে ভোলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে চরফ্যাশন উপজেলার পর্যটন এলাকা কুকরিমুকুরি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের স্লুুইস গেট না থাকায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। লালমোহনের লর্ডহার্ডিংজ ইউনিয়নের উত্তর লর্ডহার্ডিংজ পাটারি হাটের দক্ষিণ পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার রাত ৩টার দিকে প্রায় ২০ মিনিটের টর্নেডোর মতো ঘূর্ণিঝড়ে শশীগঞ্জ বাজার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

বেড়িবাঁধ ভেঙে হাতিয়ায় নলচিরা ঘাট প্লাবিত হয়ে ভেসে গেছে দোকানপাট 

নোয়াখালীর হাতিয়ায় ৩ জনের মৃত্যু : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সোনাদিয়া ইউনিয়নের ৫ কি.মি. বেড়িবাঁধ ভেঙে ছয়টি গ্রাম প্লাবিত এবং নিঝুমদ্বীপে নয়টি ওয়ার্ডে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং ৬-৭ ফুট পানিতে ডুবে গেছে। গতকাল বিকালে হাতিয়ার বয়ারচরের আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে আবুল কাশেমের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৫) ও মেয়ে মরিয়ম বেগম (১০) জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ ছাড়া বিকালে জাহাজমারা ইউনিয়নে জোয়ারের পানিতে ডুবে পেয়ারা বেগম (৫১) মারা যান। পটুয়াখালীতে নিহত ১ : পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার উত্তর লক্ষ্মীপুর এলাকার লিজাবাদ গ্রামে ঘর চাপায় নয়া বিবি (৫২) নামের এক নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ঝড়ের কবলে পড়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে পানি ভিতরে ঢুকে বিভিন্ন উপজেলায় ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে নিহত ১ : লক্ষ্মীপুরে আনোয়ারুল্লাহ নামে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত ও অপর একজন আহত হয়েছেন। সদর উপজেলার উত্তর তেওয়ারীগঞ্জ বাজারে গতকাল দুপুরে ঝড়ের সময় গাছ চাপা পড়ে আনোয়ারুল্লাহ আহত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

বরগুনায় ৪৪ গ্রাম প্লাবিত : বরগুনায় বিষখালী, বুড়িশ্বর ও বলেশ্বর নদীর জোয়ারের পানিতে বরগুনা সদর, তালতলী ও পাথরঘাটায় সাতটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সদর উপজেলার বুড়িরচরের সোনাতলা, নলটোনা ইউনিয়নের নলটোনা, ছোটবালিয়াতলী, কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের কেওড়াবুনিয়া, আয়লাপাতাকাট ইউনিয়নের বৈকালীন বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।

বাগেরহাটে ৩ হাজার বাড়িঘর প্লাবিত : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু অতিক্রম করার সময় সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের নদনদী স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। শরণখোলার বলেশ্বর নদীর প্রবল ঢেউ এবং জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধের সাউথখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

রোয়ানুর আঘাতে পতেঙ্গায় নোঙর করা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোয়ানুর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। উপকূলীয় ১৪টি জেলার পাঁচ লাখ মানুষকে সাড়ে তিন হাজার আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। ত্রাণ তত্পরতার প্রস্তুতি হিসেবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে চার লাখ করে টাকা এবং দুই হাজার টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ উপকূলে আঘাত হানার ঘণ্টা খানেক আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর