রবিবার, ২২ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সক্ষমতা বেড়েছে

জিন্নাতুন নূর

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সক্ষমতা বেড়েছে

ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল

সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতার ক্ষেত্রে পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকাগুলোয় ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত করায় সেসব এলাকার মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সর্বোপরি দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন দেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠী, সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে একান্ত সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতিমূলক প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগে উদ্ধার কাজের জন্য ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হয়েছে। এটা পৃথিবীতে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। এই স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যখনই দুর্যোগের খবর পাচ্ছেন তখন থেকেই জনগণকে প্রস্তুত হতে বলছেন। ৫ নম্বর বিপদ সংকেত পাওয়া মাত্রই মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করে দিচ্ছেন। এমনকি দুর্যোগের আগে সাইক্লোন শেল্টারে লোকজনকে নিয়ে যাওয়া এবং দুর্যোগ শেষে আবার তাদের নিজ আবাসস্থলে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করছেন। অধ্যাপক মাকসুদ কামাল উপকূলের মোট জনগোষ্ঠীর অনুপাতে দেশে স্বেচ্ছাসেবকের যে সংখ্যা তা পর্যাপ্ত বলেও মনে করেন। তার মতে, প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবককেই প্রশিক্ষণ দিতে হয়। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মনোভাব নিয়ে সবাই এগিয়ে আসেন না। যেহেতু স্বেচ্ছাসেবকরা নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে অন্যকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন সে জন্য তাদের বেছে নির্বাচন করতে হয়। সেই হিসাবে ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক পর্যাপ্ত। কিন্তু দক্ষতা বৃদ্ধি করতে তাদের নিয়মিত ও যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ কোর্স করাতে হবে। প্রতি বছর মোটিভেশনাল কোর্স ও উদ্ধার কাজে ব্যবহূত বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাহায্য করতে হবে। ড. মাকসুদ কামাল বলেন, উপকূলীয় এলাকাগুলোয় মোট তিন হাজার ৭০০টি সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়কেন্দ্র আছে। মানুষ যখনই বিপদ সংকেত পান তখনই সেখানে যান। এমনকি আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা হয়েছে যেখানে বলা আছে দুর্যোগের সময় যদি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে স্থান সঙ্কুুলান না হয়, তবে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে যে হোটেল বা সরকারি স্থাপনা রয়েছে সেখানে মানুষ বিনামূল্যে আশ্রয় পাবেন। অধ্যাপক মাকসুদ কামাল জানান, দেশে দুর্যোগকালের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তিনি বলেন, আমাদের আরও ২ হাজার ৩০০ কেন্দ্রের প্রয়োজন। অর্থাত্ মোট ৬ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র থাকা চাই। আর অবশিষ্ট আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তৈরি করাই এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। যত দিন না এগুলো তৈরি হচ্ছে ততদিন উপকূলের বিভিন্ন জেলা যেমন— কক্সবাজার ও কুয়াকাটার হোটেল মালিকদের নীতিমালা অনুসারে আশ্রয়প্রার্থীদের দুর্যোগকালীন আশ্রয় দিতে হবে। মাকসুদ কামাল জানান, সাইক্লোন থেকে উদ্ধারে সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট যৌথভাবে কাজ করছে। এ জন্য এ কাজে কিছু ক্ষেত্রে টানাপড়েন হচ্ছে। সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ড প্রোগ্রামের জন্য ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের চুক্তি হয়। সেই মোতাবেক সরকারের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ভাতা দেওয়া হয়। আর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে দুর্যোগে উদ্ধারের জন্য যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের কোনো সমন্বয় নেই। এর ফলে স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার কাজে ব্যবহূত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন— টর্চ লাইট, গামবুট, সাইকেল, রেইনকোট ইত্যাদি পাচ্ছেন না। এতে স্বেচ্ছাসেবকরা মহত্ এই কাজে উত্সাহ হারাচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের মনোবল ধরে রাখতে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য পরামর্শ দেন মাকসুদ কামাল।  এই অধ্যাপকের মতে, উপকূলে ৫ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। যে বাঁধ আছে তার অধিকাংশই পাকিস্তান আমলে তৈরি। এগুলো যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন উপকূলে ধানি জমিতে যেন লবণাক্ত পানি ঢুকতে না পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখে এর উচ্চতা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং উপকূলীয় এলাকার মাটি বসে যাওয়ায় ৫০ বছর আগের বাঁধগুলো দুর্বল হয়েছে এবং উচ্চতা হারিয়েছে। এর ওপর দিয়ে এখন গাড়ি চলাচল করছে। এ ছাড়া এগুলোর সংস্কারও হচ্ছে না। জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় এই বাঁধগুলোর ওপর গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ফলে দুর্যোগের আঘাতে বাঁধগুলো ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ দেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়েছে। উপকূলের ১৯টি জেলার মানুষকে বাঁচাতে হলে এই বেড়িবাঁধগুলো আরও শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ দেওয়ায় দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমেও অব্যবস্থাপনা কমেছে। ত্রাণ বিতরণে এখন সরকার, জনপ্রতিনিধি ও এনজিও জড়িত। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সোশ্যাল সেফটি নেট-এর প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগের আগে সহযোগিতা পাওয়ায় এ কাজে সক্ষমতা বেড়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মেকানিজম আরও বৃদ্ধি করতে হবে। জলাবদ্ধতার কারণে যেসব এলাকায় ত্রাণকর্মীরা পৌঁছাতে পারেন না সেখানে হেলিকপ্টার ও প্যারাসুটযোগে ত্রাণ পাঠানো যায় কিনা তা ভাবতে হবে। এই অধ্যাপক বলেন, এ কথা ঠিক যে, আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু এখন আমরা আগাম সতর্কতা দিয়ে মানুষকে দুর্যোগের সময় নিরাপত্তা তো দিতে পারব।

সর্বশেষ খবর