জঙ্গি অর্থের উেসর রহস্য এখনো উন্মোচন করতে পারেনি সরকার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বেশ কয়েকটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে থমকে আছে তাদের কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে দেশে জামায়াত-শিবির পরিচালিত ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নজরদারিতে রেখেছিল সরকার। তবে সেখান থেকেও কোনো তথ্য মেলেনি। এ-সম্পর্কিত এক অগ্রগতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তারা শুধু রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ প্রবেশের শুরু থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত লেনদেনের তদন্ত করতে পারে। কিন্তু ওই অর্থ চ্যানেলের বাইরে চলে যাওয়ার পর সেটি কীভাবে, কোথায়, কী কারণে লেনদেন হচ্ছে সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয় সীমিত।
গত নভেম্বরে জঙ্গি অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানে জামায়াত-শিবির সমর্থিত সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ওই দায়িত্ব দেয়। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৈরি করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকা সংবলিত ২১৬ পৃষ্ঠার একটি বিশদ প্রতিবেদনও তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। বলা হয়েছিল, জঙ্গি অর্থের উৎস অনুসন্ধানের পাশাপাশি যে কোনো ধরনের লেনদেন সন্দেহজনক হলেই যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানানো হয়। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তারা চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সন্দেহজনক ছয়টি কেইস সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করেছে। সীমিত ক্ষমতা নিয়ে এর বেশি কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশে ব্যবসারত ইসলামী ব্যাংকগুলোর জাকাতের অর্থ জঙ্গি তহবিলে যাচ্ছে বলে সন্দেহ ছিল সরকারের। তবে সেটি কীভাবে যাচ্ছে সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এমনকি ইসলামী ব্যাংকগুলোতে রাখা সুদমুক্ত আমানতের লভ্যাংশ কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কেও জানতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সমস্যা সমাধানে এখন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য একটি পৃথক আইন করার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও জোরদারকরণ সম্পর্কিত ওই প্রতিবেদনটি ২৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠান বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের কোনো লেনদেনে সুদের আদান-প্রদান করতে পারে না। তারা শরিয়ার দুটি নীতি—আল-ওয়াদিয়া ও মুদারাবা অনুযায়ী আমানতকারীদের থেকে আমানত গ্রহণ করে। মুদারাবায় আমানতকারীদের চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ প্রদান করা হয়। কিন্তু শরিয়া নীতি অনুযায়ী আল-ওয়াদিয়ায় আমানতকারীদের কোনো লাভ প্রদান করা হয় না। এ জন্য আল-ওয়াদিয়া আমানতের ক্ষেত্রে লভ্যাংশেরও হিসাব করা হয় না। এ ক্ষেত্রে আমানতকারীর উদ্বৃত্ত লভ্যাংশ ইসলামী ব্যাংকগুলোর কোনো হিসাবে জমা হওয়ার সুযোগ নেই বিধায় এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’ এসব ক্ষেত্রে তথ্য পেতে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়নের সুপারিশ করে বিএফআইইউ বলেছে, এতে ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত জটিলতা হ্রাস পাবে। মালয়েশিয়ায় (যেখানে মালয়, চায়নিজ ও ভারতীয় তামিল জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে) ইসলামী ব্যাংকিং আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ধরনের জটিলতা নিরসন করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কে যদি কোনো আইনের সংস্কার বা নতুন কিছু করতে হয়, তবে সেটিকে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নটি সবার আগে। অর্থের উৎস বন্ধ করতে না পারলে জঙ্গিবাদের হাত থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা থাকলে সরকারের উচিত রাজস্ব বোর্ডসহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানো। জঙ্গি অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়সারা কোনো জবাব রাষ্ট্রের কাম্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।