সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

উত্তাল ব্রিটিশ রাজনীতি

ভেটো দেবে স্কটল্যান্ড, কে হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

উত্তাল ব্রিটিশ রাজনীতি

গণভোটের ফলে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিক্ষোভ। লন্ডন থেকে শনিবার তোলা ছবি —এএফপি

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছিন্ন হওয়ার গণরায়ের পর উত্তাল হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ রাজনীতি। ইতিমধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের স্থানে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে ভিন্নমত তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিতে। পাশাপাশি অস্থির হয়েছে বিরোধী লেবার পার্টিও। লেবার দলীয় প্রধানের পদত্যাগের দাবি তোলা ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে করা হয়েছে বহিষ্কার। এ পরিপ্রেক্ষিতে গণপদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে অন্য এমপিরা। এমপিদের আরেক পক্ষ বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নতুন করে গণভোটের দাবি তোলা নাগরিক পিটিশনে স্বাক্ষরের সংখ্যা তিরিশ লাখ ছাড়িয়েছে। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে স্কটল্যান্ডের পক্ষ থেকে সম্ভব সব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে স্কটিশ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছিন্নতায় ভেটো দেবে স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট। জানা যায়, গণভোটের পর ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা উঠে এসেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে। ‘বরিসকে ঠেকাতে যুদ্ধে টোরিরা (কনজারভেটিভ পার্টি)’ এমন অভিন্ন শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ ও ডেইলি মেইলসহ অন্যরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণভোটের পর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এরপর তার উত্তরসূরি হিসেবে এ পদে আসার সমূহ সম্ভাবনা লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসনের। কিন্তু এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তার দলেরই বড় বড় নেতারা। এ ক্ষেত্রে সামনে থেকে বরিসকে প্রতিহত করার লড়াইয়ে নেমেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে। এই প্রতিহতে আরও আছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ও সাউথ ওয়েস্ট সারে পার্লামেন্টের সদস্য জেরেমি হান্ট, শিক্ষা, নারী ও সমতাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিকি মরগান, ওয়ার্ক অ্যান্ড পেনশনবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী স্টিফেন ক্রাব, ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিমন্ত্রী অ্যানড্রিয়া লিডসাম ও অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন। সবশেষে লড়াইয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন লিয়াম ফক্স। তাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নপন্থি ক্ষমতাসীন দলের নেতা মাইকেল হেসেলটাইম বলেছেন, ব্রেক্সিট গণভোটের কারণে কনজারভেটিভ দলের মৃত্যু ঘটতে পারে। স্কাই নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিনকে উত্খাত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গতকাল ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বেনকে বরখাস্ত করেছেন করবিন। এর প্রতিবাদে তার অধীনে ছায়া মন্ত্রিসভা থেকে গণহারে পদত্যাগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলা চলে, ‘গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ’ হয়েছে ব্রিটেনের লেবার পার্টি। এখন ছায়া মন্ত্রিসভার কমপক্ষে অর্ধেক সদস্য পদত্যাগ করে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বের ইতি ঘটাতে চাইছেন। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্যবিষয়ক ছায়ামন্ত্রী হিদি আলেকজান্ডার। পদত্যাগপত্রে হিদি লিখেছেন, ‘আপনাকে একজন (দলীয়) আদর্শ অনুসরণকারী হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দেশে এখন যে চ্যালেঞ্জ তার উত্তর দেওয়ার মতো সক্ষমতা আপনার আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আরেকজন ছায়ামন্ত্রী স্কাই নিউজকে বলেছেন, ‘ছায়া মন্ত্রিপরিষদ, পার্লামেন্টারি লেবার পার্টি ও তৃণমূল পর্যায়ের সদস্যদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। যথেষ্ট হয়েছে, আর না’। তবে জেরেমি করবিন জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন নেতা সদস্যদের শক্ত ম্যান্ডেট ছাড়া পদত্যাগ করবেন না।

ভেটো দেবে স্কটল্যান্ড : স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন গতকাল বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্নতা ঠেকানোর সব চেষ্টা করবে স্কটল্যান্ড। স্কটিশ পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত হয়েছে ভেটো দেওয়ার। স্কটল্যান্ডের মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ইইউর সদর দফতরের সঙ্গে মঙ্গলবার আলোচনা শুরু হবে। ব্রিটেন বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া বন্ধ না করলেও আমরা ইইউর সঙ্গে যাব। আমাদের জনগণেরও তাই মত। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার আরও বলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের থাকার পক্ষে ২০১৪ সালে গণভোটের রায় এখন মূল্যহীন। স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় গণভোটের সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।

‘গণভোটের রায় ছিল পাগলামো’ :  গণভোটকে পাগলামো বলে আখ্যায়িত করেছেন লেবার দলের সিনিয়র এমপি ও সাবেক মন্ত্রী ডেভিড ল্যামি। রায় বাস্তবায়ন বন্ধ করতে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পার্লামেন্টের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, এই পাগলামো বন্ধ করুন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রশ্নে গণভোটের রায়কে বানচাল করে দিন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের কাছে গণভোটের রায় অবশ্যই দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্নকে বন্ধ করতে হবে পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে। আসলেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমাদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত কিনা তা নির্ধারণে প্রয়োজন আমাদের সার্বভৌম পার্লামেন্টে ভোট। গণভোট ছিল শুধু একটি পরামর্শবিষয়ক ঘটনা। অবশ্য পালনীয় গণভোট নয়।

ব্রিটিশ ধনকুবেরের শঙ্কা : ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী ও ধনকুবের জর্জ সরোস বলেছেন, ইইউ ছাড়ার কারণে ব্রিটেন অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো থাকবে কী থাকবে না তার চেয়ে বড়ো কথা এর ফলে দেশটির অর্থনীতি ও জনগণ স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদের মধ্যেই দুর্ভোগে পড়বে। অর্থাৎ গণভোটের সিদ্ধান্ত ব্রিটেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ১৯৯২ সালে মুদ্রা বাণিজ্যে ব্যাপক মুনাফা করা সরোস বলেন, বেক্সিটের কারণে পাউন্ডের মূল্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমবে। অর্থনীতিতে যে পরিণাম তৈরি হবে তা ২০০৭-২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সাথে তুলনীয় হবে।

দ্বিতীয় দফা গণভোটের সমর্থন বাড়ছে : ব্রেক্সিটের পক্ষে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার পর অনেক ব্রিটিশ ভোটারই এখন মনে করছেন দ্বিতীয়বার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে থাকার রায় দেবেন। এই দাবিকে আরও জোরালো করতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বরাবর একটি অনলাইন পিটিশন চালু করেছেন উইলিয়াম অলিভার হিলি নামে এক ব্রিটিশ নাগরিক। গত ২৪ মে চালু করা ওই অনলাইন পিটিশনে শুরুতে স্বাক্ষরের হার কম থাকলেও দুই দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা গণভোটের দাবির প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৩২ লাখ ১৮ হাজারের বেশি ব্রিটিশ এই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন।

কে হচ্ছেন পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী : ডেভিড ক্যামেরনের পদত্যাগের ঘোষণার পরপরই শুরু হয়েছে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা। সম্ভাব্য তালিকায় সবচেয়ে জোরালোভাবে আছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন। ইইউ ছেড়ে আসার দাবিতে নিজ দলের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামা বরিসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন। তালিকায় আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে অসবোর্ন। অবশ্য ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলছে, প্রধানমন্ত্রী পদ দূরে থাক, অর্থমন্ত্রীর পদেই জর্জ অসবোর্নের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে উঠছে। তার বদলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন বিচারমন্ত্রী মাইকেল গোভ। তবে দলের অনেকেরই ধারণা, পুরো দেশের ভোট জেতার মতো যথেষ্ট ‘নরম্যাল’ মাইকেল গোভ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর