বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

ডিসিদের ১৯ দফা নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বক্তব্য দেন —বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজধানীর কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ত্বরিত ব্যবস্থা দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে। তারা (সন্ত্রাসীরা) সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল। বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা যে কোনো ধরনের নাশকতা ঘটানোর জন্য তৈরি হয়েছিল। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বড় ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শাপলা হলে শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কল্যাণপুরে সন্ত্রাসীরা ঘটনা ঘটাবে বলে প্রস্তুতি নিয়েছিল। মধ্যরাতেই সে জায়গা ঘেরাও করে রাখা হয়। সকাল ৫টায় সেখানে অপারেশন চালানো হয়। অপারেশনে নয়জন সন্ত্রাসী মারা যায়। একজন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে আর একজন পালিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই না আমাদের দেশটা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হোক। সন্ত্রাস অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে। মানুষের জীবন নিরাপদ করতে হবে। এটাই সব থেকে বেশি প্রয়োজন। আমরা সন্ত্রাসের কাছে মাথানত করব না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশে নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। একদল ধর্মান্ধ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে। বিগত বেশ কিছু দিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাসীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করে আসছে। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তারা। মানুষ খুন করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের নামে যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামকে কলুষিত করছে। এরা পবিত্র ইসলামের বন্ধু নয়, এরা ইসলামের শত্রু। এই সন্ত্রাসের কাছে মাথানত করব না। জনগণের মধ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। সারা দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এদের নির্মূল করব। বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের ঠাঁই হবে না। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ও ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় আমাদের নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে আমরা উত্তরণ করতে সক্ষম হব। আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। শেখ হাসিনা বলেন, এ সমস্যা একক প্রশাসনিক প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এটা সম্মিলিতভাবে সমাধান করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, সারা দেশে জঙ্গিবাদবিরোধী ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে, এটিকে কাজে লাগাতে হবে। সন্ত্রাস মোকাবিলায় জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তৃণমূল থেকে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করে কোথায়, কারা সন্ত্রাস করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যেন সঠিক শিক্ষা পায় সে জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহায়তা করতে হবে। তিনি বলেন, সন্ত্রাস মোকাবিলায় জেলা প্রশাসকদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে শুরু করে  সর্বস্তরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা অবস্থা তৈরি করতে হবে। সর্বোচ্চ মেধা, শ্রম, ঐক্য নিয়ে এই সন্ত্রাসকে রুখতে হবে। তিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়কার কথা তুলে ধরে বলেন, বর্তমানে যে সমস্যা দেখা গেছে সেটা হলো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড। কিন্তু এটা নতুন নয়। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় একই দিনে দেশের ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন সময় আমি নিজেও বারবার গ্রেনেড বা বোমা হামলার সম্মুখীন হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে চলি। আমাদের সামনে যে বাধা তা মোকাবিলা করেই আমরা সামনে এগিয়ে যাব। কেউ আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারবে না। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে দাঁড় করাব। সবাই মিলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, শান্তিময় সোনার বাংলা গড়ে তোলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমসহ তিনজন জেলা প্রশাসক ও একজন বিভাগীয় কমিশনার বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বৈষম্য দূর করে জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলাই বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। জনগণের সেবা আরও সুনিশ্চিত করব। তিনি বলেন, আমরা চাই এদেশের কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না, কেউ না খেয়ে থাকবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হয়েছি, জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে তুলছি। এখন ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ব।

জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরু প্রধানমন্ত্রীর ১৯ নির্দেশনা : জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দমনে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গতকাল তার কার্যালয়ে চার দিনের ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী  ডিসিদের ১৯টি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখতে বলেন। তিনি বলেছেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে আপনাদের বহুবিধ কাজ। এসব কাজের মধ্যেই ১৯টি নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে মুক্ত আলোচনায় সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন ডিসিরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ১৯টি বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার জন্য ডিসিদের নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে- ১. সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন। ২. জঙ্গি-সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজ জীবনে সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ডিসিদের আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৩. নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, যৌতুক, ইভ টিজিং এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। ৪. প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্রতী হতে হবে। ৬. জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব দিতে হবে। ৭. শিক্ষার সব স্তরে, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার হ্রাস এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ৮. ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ৯. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ১০. ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ১১. পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ওই সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলী অনুসারে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিহত হবে। ১৩. সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম্য আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। ১৪. শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৫. ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ১৬. নারী উন্নয়ন নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ১৭. শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইতিহাস চেতনা, জ্ঞানস্পৃহা বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে। ১৮. কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান এবং এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ১৯. পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী, জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে।

এ ছাড়া পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। 

এদিকে ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মুক্ত আলোচনা শুরু হয়। এতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক মিলিয়ে অন্তত ২৫ জন কথা বলেন। একাধিক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্ত আলোচনায় মূলত সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে।

একজন ডিসি জানান, সুশাসনের ওপর ডিসিরা গুরুত্ব দিয়েছেন। সরকারের সামগ্রিক উন্নয়ন কাজ নিয়ে জনগণের সন্তুষ্টির কথা তুলে ধরে তারা বলেছেন, মানুষ এখন দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন দেখতে চায়। এ ব্যাপারে ডিসিরা প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা ও পরামর্শ চান।

একাধিক ডিসি জানিয়েছেন, মুক্ত আলোচনায় ডিসিরা যেসব ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন তার সবই প্রধানমন্ত্রীর ১৯টি নির্দেশনায় চলে এসেছে।  তাই নতুন করে কোনো অভিযোগ ও অনুযোগের কথা কেউ বলেননি।

সর্বশেষ খবর