বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেটে মিলে খা টিআর কাবিখা

লোকসান হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

টেস্ট রিলিফ ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অনুকূলে কেনা চাল ও গমে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে সরকার। ৩৬ হাজার টাকা টনের চাল বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৭ হাজার টাকা আর ২৬ হাজার টাকা টনের গম বিক্রি হচ্ছে ১৬ হাজার ৫০০ টাকায়। টিআর ও কাবিখার জন্য সরকার এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে যে চাল ও গম বরাদ্দ দেয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে তার মূল্য ধরে দেওয়া হয় যথাক্রমে চাল টনপ্রতি ৩৬ হাজার ৬৩৪ টাকা এবং গম টনপ্রতি ২৬ হাজার ৫৯৫ টাকা। কিন্তু চাল ও গম সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে বিক্রির সময় সেই চাল ও গমের দাম কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। জানা গেছে, সারা দেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় টিআর ও কাবিখার চাল-গম কেনার জন্য সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রয়েছে, যাদের কাছে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা অনেকটা জিম্মি। ফলে সিন্ডিকেটের নির্ধারিত মূল্যেই চাল ও গম বিক্রি করতে বাধ্য হন জনপ্রতিনিধিরা। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরে টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের বিপরীতে চাল সরবরাহ করেছে চার লাখ ১৭ হাজার ২৪২ মেট্রিক টন। আর গম সরবরাহ করেছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৭৬ মেট্রিক টন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গত অর্থবছরের একটি পত্র থেকে জানা গেছে, তারা কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১৫০ টন চালের মূল্য পরিশোধ করেছে ১৮০ কোটি ২৪ লাখ ১৫ হাজার ৭০৩ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি টন চালের মূল্য পড়ে ৩৬ হাজার ৬৩৪ টাকা। এই হিসাব ধরে দেখা যায়, গত বছর টিআর ও কাবিখা খাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে পরিমাণ চাল ও গম সরবরাহ করেছে, তাতে শুধু গত অর্থবছরই এ খাতে সরকারকে গচ্চা দিতে হয়েছে এক হাজার ৬৩ কোটি টাকা, যার পুরোটাই গেছে চাল ও গম সিন্ডিকেটের পকেটে। অথচ এ টাকা পাওয়ার কথা ছিল গ্রামীণ দরিদ্র ও কর্মক্ষম শ্রমজীবী মানুষদের। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকার বছরের নির্দিষ্ট সময়ে টিআর-কাবিখা কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের হাতে কাজ ধরিয়ে দেয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতা এবং সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবে টিআর ও কাবিখা প্রকল্প আশানুরূপ কাজে আসছে না। বরং টিআর-কাবিখা এখন পরিণত হয়েছে বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করা প্রকল্পে। অভিযোগ আছে, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের চাল ও গম নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসা করে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে কতিপয় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী পরিচয় দেওয়া কিছু লোকের পকেটে, যারা সরকারের উন্নয়নে বা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো অবদান রাখছেন না। ফলে বছরের পর বছর ধরে এই একই পদ্ধতিতে টিআর-কাবিখার নামে বরাদ্দ দেওয়া চাল ও গম লুটপাট হচ্ছে। কেন সরকার বেশি দামে কিনে কম দামে সরবরাহ করছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদমাধ্যমের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, সরকার জনগণের পাশে দাঁড়াতে চায়। সে জন্য কিছুটা ভর্তুকি দিয়ে হলেও এই কর্মসূচি চালিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, এ নিয়মটা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের আমলে। তাদের তৈরি করা নিয়মের কারণেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সে জন্য একটু বেশি মূল্যে তাদের কাছ থেকে চাল-গম কেনা হয়েছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে ৩০০ টন বিশেষ ও ১৫৪ টন সাধারণ টিআর এবং ৩০০ টন বিশেষ ও ১৬৬ টন সাধারণ কাবিখা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশেষ বরাদ্দকৃত টিআর ও কাবিখার অর্ধেক (৩০০ টন) বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা, হাটবাজার, ইউনিয়ন পরিষদ ও জনসাধারণের বাড়ি, যেখানে বিদ্যুৎ-সুবিধা নেই, সেখানে সোলার সিস্টেম (সৌরবিদ্যুৎ) স্থাপন করতে খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে ধান-চালের দাম কমে যাওয়ায় এবং সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় টনপ্রতি চাল ১৬ থেকে ১৭ হাজার আর গম ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ছাড়া সারা দেশের সব এমপি ও সংরক্ষিত মহিলা এমপি, বিভাগীয় কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসকদের জন্য বছরে দুবার করে টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টন চাল ও গম কিনতে হয় সরকারকে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাশিয়া, রোমানিয়া ও ফ্রান্স থেকে মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিআর ও কাবিখার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। জনগণকে এর সুফল দিতে হলে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সংসদ সদস্যদের অনেকে ইতিমধ্যে চাল ও গমের বদলে এসব কর্মসূচিতে নগদ অর্থ বরাদ্দ করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের হুইপ আতিউর রহমান আতিকসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এ দাবি তুললে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আশা করি প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করে এটা বাস্তবায়ন করবেন।’ কিন্তু সে উদ্যোগ এখন পর্যন্ত ফাইলবন্দী বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর