শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

কার্গো ভিলেজে ২০ মাফিয়া

মির্জা মেহেদী তমাল

কয়েক দিন আগের ঘটনা। শাহজালাল বিমানবন্দর কার্গো থেকে খালাসের পর সেই পণ্য একটি কাভার্ড ভ্যানে তুলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের এলবিয়ন ল্যাবরেটরির ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ওই কেমিক্যাল নিয়ে কাভার্ড ভ্যানটি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ওই দিনই খবর আসে মালামালসহ কাভার্ড ভ্যানটি গায়েব। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় পরদিন কাভার্ড ভ্যানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার কয়েক মাস আগে সালওয়া করপোরেশনের আমদানি করা গার্মেন্ট সামগ্রী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো  গুদামে আসে। চার দিন পর প্রতিষ্ঠানটি মালামাল খালাস করতে গিয়ে দেখে তা নেই। থানায় জিডি করা হয়। খোঁজ মেলেনি তাদের পণ্যের। কার্গো ভিলেজ থেকে খালাস হওয়া পণ্য কাভার্ড ভ্যানসহ যেমন উধাও হচ্ছে পথেঘাটে, তেমনি গুদামের ভিতর থেকেও লোপাট হচ্ছে মূল্যবান সব সামগ্রী। এসব ঘটনা এখন কার্গো ভিলেজের নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কয়েকশ টন পণ্যের কোনো খবর নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় তারা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে। এ ছাড়া ভুয়া কাগজে মালামাল খালাস করে নেওয়ার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল কার্গো ভিলেজের এই লুটপাট নিয়ন্ত্রণ করছে ২০ মাফিয়া। এদের মধ্যে রাজধানীর দুর্ধর্ষ অপরাধী ছাড়াও রয়েছে কার্গো পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামধারী কয়েকজন নেতা। আরও রয়েছে সিএন্ডএফের কতিপয় ব্যবসায়ী এবং বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের অসাধু কিছু কর্মচারী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাদের কারণে পুরো কার্গো এখন অরক্ষিত। বিমানবন্দর ও কার্গো নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্রিটিশ কোম্পানি রেড লাইনের কোনো কর্মকাণ্ডও কোনো কাজে আসেনি। মাফিয়াদের হাতে পুরো কার্গো, আমদানিকারক ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কাস্টমস ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো জানিয়েছে, কার্গোর মালামাল লুটপাটকারীরা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, তাদের গ্রেফতার করলেও আটকে রাখা যায় না। সোনারগাঁ এলাকায় পণ্যভর্তি ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনায় পরিবহন মালিক সমিতির নেতা মুজিবর ও আনসু গ্রেফতার হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই তারা জামিনে ছাড়া পায়। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, কার্গো ভিলেজে অন্তত ২০ জন রয়েছে, যারা এসব দুর্ধর্ষ সব অপরাধে জড়িত। এদের মধ্যে আবদুল হাই মুন্না, মজিবুর, নুরু, ইমান, হারুন, কালাম, আবুল, নুরুল ইসলাম, মাইজ্জা মিয়া, আকরাম, আলামিন, মোক্তার, আদম আলী, দেলোয়ার, কাইয়ুম অন্যতম। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মালামাল লুটের মামলা রয়েছে। এদের অধিকাংশই পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। এরা নিজস্ব পরিবহনে মালামাল নিয়ে সুযোগ-সুবিধা মতো নিজেদের লোকজন দিয়ে মালামাল ছিনতাই করে থাকে। এ ছাড়া কাগজ জালিয়াতি করে মালামাল খালাস করছে এই চক্রটি। এমন ঘটনার সব প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। আর এদের সহযোগিতা করছে সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে বিমানের অসাধু কিছু স্টাফ, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট। ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, মাফিয়াদের হাতে কার্গো জিম্মি। তারা কার্টন  ভেঙে, পলিথিন খুলে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান পণ্য। গার্মেন্ট এক্সেসরিজ,  মোবাইল ফোন, কেমিক্যাল থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই এখান থেকে চুরি করছে না তারা। হাজার কোটি টাকার বেশি চুরি ও হারিয়ে যাওয়া মালামালের অভিযোগ বিমানের ক্লেইম শাখায় ফ্লাইলবন্দি হয়ে আছে। গত দুই মাসে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রেজিস্টার তল্লাশি চালালে জালিয়াতির বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়ে। একটি লকারে (জিআর নম্বর ১৫০/৮) ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ রুপি জমা রাখা হলেও সেখানে আসল রুপি পাওয়া গেছে মাত্র সাড়ে চার হাজার। বাকি ২৪ লাখ ৯০ হাজার জাল রুপি। একইভাবে (জিআর নম্বর ২২৩/৮) ১৩ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলারের স্থলে ১৩ হাজারই পাওয়া গেছে জাল। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বিমানের কার্গো আমদানি ভবনটি চুরি আর লুটপাটের এখন স্বর্গরাজ্য। এখানে পণ্য ডেলিভারিতে কোনো ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। কাগজে-কলমে সংরক্ষিত বলা হলেও কার্গো গুদামের পুরোটাই অরক্ষিত। গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, মোবাইল ফোনসেট, স্বর্ণালঙ্কার, হীরা, মূল্যবান কেমিক্যাল, ওষুধের কাঁচামাল, অস্ত্র— এমন কোনো পণ্য নেই এখান থেকে চুরি হচ্ছে না। সিভিল এভিয়েশন, বিমান, কার্গো টার্মিনালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, থানা পুলিশ, বিমান সিকিউরিটি, কাস্টমসসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত। চোরাই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সব গেটই ব্যবহার করছে। তারা গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন গেট দিয়ে অবাধে ভিতরে যাচ্ছে, আবার নির্বিঘ্নে বেরিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোটি কোটি টাকার আমদানি পণ্য টার্মিনালে এসে জমা হলেও তা ভালোভাবে সংরক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা নেই। পণ্য টার্মিনালে খাদ্যের সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল, কাপড়ের সঙ্গে ইলেকট্রনিক্স এবং পচনশীল দ্রব্যের সঙ্গে অপচনশীল লোহা-লক্কড় রাখা হচ্ছে যত্রতত্র। মালামাল রাখার কোনো নিয়মকানুন নেই। অতি মূল্যমান স্টিকার লাগানো মালামাল রাখা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। বিমান কর্তৃপক্ষ মালামাল বহনে লোডার রাখলেও তারা ব্যস্ত লাগেজ কাটার ধান্ধায়। কর্মকর্তাদেরও মালামাল ওঠানামা ও ভালোভাবে সংরক্ষণের দিকে কোনো খেয়াল নেই। প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্গো টার্মিনালে অনেক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা কেমিক্যাল বদলে সাদা গুঁড়া দিয়ে ভরে রাখে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা। কার্গো টার্মিনালে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসায়ীর চেয়ে পরিবহন এবং অবাঞ্ছিত লোকজনের দাপটই বেশি। কার্গো গুদামের নিষিদ্ধ এলাকায়ও তাদের অবাধ যাতায়াত। তাদের সঙ্গে বিমানের একশ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। তাদের মাধ্যমে কার্গোর মালামাল চুরি, মিথ্যা ঘোষণা, ভুয়া ডকুমেন্টের মাধ্যমে বেশি মালামাল খালাসের ঘটনা ঘটে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর