রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাগীব আলীকে নিয়ে যত কথা

সিলেটের সেই দানবীর হঠাৎ কেন খলনায়ক

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

রাগীব আলীকে নিয়ে যত কথা

বিতর্ক যেন নিত্যসঙ্গী। বিশিষ্ট শিল্পপতি রাগীব আলী ইতিবাচক কাজের জন্য একদা ‘দানবীর’ নামে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন যতই বদনামই শোনা যাক না কেন, সুন্দর সুন্দর কিছু কাজও তিনি করেছিলেন। যেমন— বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান। জনমন থেকে সেসব সুন্দর উধাও হয়ে গেছে। রাগীব আলী নিজেই নিজের সুন্দর কাজগুলো মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছেন। তার নেতিবাচক কাজগুলো আড়াল করে ফেলেছে তার নেতিবাচক কাজ।

সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্রাবাসের জায়গা দখল করে ‘মধুবন সুপার মার্কেট’ নির্মাণ করে তার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া শুরু। ছাত্রাবাসের জায়গা দখলের প্রতিবাদে ওই সময় সিলেটে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলনে নামেন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা। অভিযোগ আছে, সেই আন্দোলনে জড়িত অনেক নেতাকে কারাবরণ করতে হয় রাগীব আলীর প্রভাবে। এরপর ১৯৯০ সালে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে রাগীব আলী দখল নেন সিলেটের তারাপুর চা বাগান। দেবোত্তর ওই সম্পত্তির সেবায়েতও বনে যান তার ছেলে আবদুল হাই। এ নিয়ে সিলেটজুড়ে বিতর্কিত হন এই শিল্পপতি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একাধিক মামলা হয় রাগীব আলী, তার ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। প্রভাব খাটিয়ে এসব মামলা এতদিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন রাগীব আলী। দীর্ঘদিন পর গত ১৯ জানুয়ারি তারাপুরে রাগীব আলীর  দখলদারিত্বকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। এদিকে, জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূমি আত্মসাৎ ও প্রতারণার দুটি মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলেমেয়েসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গত বুধবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। গ্রেফতার এড়াতে ছেলেকে নিয়ে ওইদিন বিকালে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান রাগীব আলী। গুরুতর ব্যাপার এই যে, রাগীব আলী জামায়াত-শিবিরকে সক্রিয় সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরশাদ আমলে জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সিলেটে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তা সত্ত্বেও তখন রাগীব আলী তার নিজ এলাকায় সাঈদীকে ওয়াজ করার জন্য নিয়ে আসেন। এমনকি নিজের মালনিছড়া চা বাগানের বাংলোয় সাঈদীর থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সাঈদীর কয়েকটি বইয়েরও প্রকাশক রাগীব আলী। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাগীব আলী নিজেকে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ বলে প্রচার করতে থাকেন। তার আশীর্বাদপুষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন দিয়ে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করারও দাবি ওঠান তিনি। এ নিয়ে সিলেটে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাগীব আলীকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তো দূরের কথা, পক্ষের লোক বলে মানতে নারাজ মুক্তিযোদ্ধারা। এ ব্যাপারে সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, রাগীব আলী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তো নয়ই, উল্টো তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক। সম্প্রতি রাগীব আলী নিজের নামের সামনে ‘ডক্টর’ ও ‘সৈয়দ’ পদবি যুক্ত করেছেন। আগে কখনোই তার নামের সঙ্গে এসব ‘অলঙ্কার’ ছিল না। এ নিয়ে অনেক হাসাহাসি ও রসিকতা চলেছে অনেক দিন। কয়েক বছর আগে নিজ গ্রাম তালিবপুরের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে ‘রাগীবনগর’ করার চেষ্টা চালান তিনি। ওই সময় স্থানীয় জনতার প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হন রাগীব আলী। বিতর্ক পিছু না ছাড়লেও বৃহত্তর সিলেটে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডও করছেন রাগীব আলী। রাগীব আলী নিজ নামে, তার স্ত্রী ও বাবার নামে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে তারাপুর চা বাগানের ভেতর গড়ে তোলা রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ অন্যতম। সিলেটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন এই কলেজে। হাসপাতালেও প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য আসেন হাজারো মানুষ। ওই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে ঘিরে তারাপুর এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এ ছাড়াও রাগীব আলী সিলেটের শিক্ষার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনটি ক্যাম্পাসে চলছে তার প্রতিষ্ঠিত লিডিং ইউনিভার্সিটির পাঠদান। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে করেছেন শাহজালাল প্রতিবন্ধী ইনস্টিটিউট। এ ছাড়া অসহায়দের সহায়তায় কাজ করছে রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর নির্মাণ, গরিব-অসহায়দের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন রাগীব আলী। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বেশকিছু লোক হজব্রত পালন করতে যান।

সর্বশেষ খবর