পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দেশটির কোনো সরকারই কখনো চটাতে চায় না। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মুহূর্তে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে অনেকটা হুঁশিয়ারি করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। প্রধানমন্ত্রীর কথা, হয় সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন, না হলে গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ুন। পাকিস্তানি সংবাদপত্র ‘ডন’-এ এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
মঙ্গলবার নওয়াজ শরিফ একটি উচ্চপর্যায়ের গোপন বৈঠক ডাকেন। এতে নওয়াজ শরিফ নিজেই সভাপতিত্ব করেন।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী, কয়েকজন সচিব এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সেনার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ডিজি জেনারেল রিজওয়ান আখতারসহ শীর্ষ কর্তারা সেই বৈঠকে ছিলেন। নওয়াজ শরিফের ভাই তথা দেশটির পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও বৈঠকে ছিলেন। ডন জানায়, বৈঠকে নজিরবিহীনভাবে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে সরকার এবং আইএসআই কর্তাদের মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আচরণের বিরুদ্ধে সরকারি কর্তাদের এভাবে মুখ খুলতে এবং সেনাকে হুঁশিয়ারি দিতে আগে কখনো দেখা যায়নি বলে জানায় ডন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব ওই বৈঠকে প্রথমে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন। তাতে দেখানো হয়, উরি হামলার পর থেকে পাকিস্তান কীভাবে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব থেকে। পাকিস্তান গোটা বিশ্বকে নিজেদের অবস্থান বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও প্রায় সব বৃহৎ শক্তি কীভাবে পাকিস্তানকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, সে কথাই তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব। তার প্রেজেন্টেশন শেষ হতেই সরকারের তরফ থেকে সেনাবাহিনী এবং আইএসআইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ‘সরকার যদি নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়, তা হলে সেনার নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দা সংস্থা যেন কোনো হস্তক্ষেপ না করে।’ কারণ কোনো জঙ্গি বা নিষিদ্ধ নেতা আটক হলে পরে আইএসআই কলকাঠি নাড়িয়ে তাকে মুক্ত করার জন্য ওঠেপড়ে লাগে। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে পাঠানকোট জঙ্গি হামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করার এবং মুম্বই জঙ্গি হামলার অভিযুক্তদের বিচার ফের শুরু করার নির্দেশও দেওয়া হয়। নওয়াজ শরিফের ওই গোপন বৈঠক নাকি মোটেই মসৃণ ছিল না। পাক পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফের সঙ্গে আইএসআই কর্তাদের তীব্র বাদানুবাদ হয় বলে ‘ডন’-এ লেখা হয়েছে। জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেওয়ার যে অভিযোগকে ঘিরে পাকিস্তান আজ গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বসেছে, তার জন্য আইএসআই তথা সেনাবাহিনীই দায়ী বলে প্রকারান্তরে অভিযোগ করেন শাহবাজ শরিফ। পররাষ্ট্র সচিব যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তাতে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থান পায়। বলা হয়, পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে একা হয়ে যাওয়ার মুখে রয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে যদি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা মতো ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে এ সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। ভারতের বিষয়েও তিনি মুখ খোলেন। বলেন, ভারতের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঠানকোট তদন্ত সম্পন্ন করা ও জৈশ ই মোহাম্মদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ। পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রিজওয়ান আখতার জানতে চান, পাকিস্তানকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়া প্রতিরোধে কী কী করা যেতে পারে। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাসুদ আজহার ও জৈশ ই মোহাম্মদ, হাফিজ সাঈদ, লস্করে তৈয়বা ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাহিদা মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। জবাবে জেনারেল রিজওয়ান বলেন, যাকে প্রয়োজন তাকেই গ্রেফতার করা উচিত সরকারের। তাতে সেই ব্যক্তি যদি কোনো বিশেষ কেউ হন বা নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো গ্রুপের সদস্যও হয়। এ পর্যায়ে অপ্রত্যাশিতভাবে হস্তক্ষেপ করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। তিনি বলেন, বেসামরিক কর্তৃপক্ষ যখনই কোনো সুনির্দিষ্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তখনই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তাদের মুক্ত করার জন্য কাজ করেছে পর্দার আড়ালে। এ নিয়ে কথার লড়াই ছড়িয়ে পড়ে ওই বৈঠকে। তখন উত্তেজনা প্রশমনে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ কথা বলা শুরু করেন। তিনি জেনারেল রিজওয়ানকে উদ্দেশ করে বলেন, যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় নীতি। এমন নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই বর্তমানে যে সংকট তাতে আইএসআই মহাপরিচালককে দায়ী করা হচ্ছে না। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, তারা মনে করেন পররাষ্ট্র সচিবের মন্তব্য ও মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের হস্তক্ষেপ আগেই সাজিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, যাতে সেনাবাহিনীকে তত্পর করা যায়।কাশ্মীরে সেনা ঘাঁটিতে ফের জঙ্গি হামলা, নিহত ৩ জঙ্গি : ভারতের কাশ্মীরের সেনা ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ফের হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। গতকাল ভোরে উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার হান্ডওয়ারাতে ৩০ নম্বর রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ঘাঁটিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। কিন্তু ভারতীয় সেনারা সজাগ থাকায় জঙ্গিরা সফল হতে পারেনি। সেনাদের পাল্টা জবাবে তিন জঙ্গি নিহত হয়। এ সময় দুই পক্ষের গুলি চলে প্রায় ২০ মিনিট। সেনা সূত্রে খবর, গোলাগুলি থামার পরই জঙ্গিদের খোঁজে জোর অভিযান শুরু করেছে ভারতীয় সেনা। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর উরিতে জঙ্গি হামলায় ১৯ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরই ২৯ সেপ্টেম্বর এলওসি পেরিয়ে পাক শাসিত কাশ্মীরে গিয়ে ৭টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনা অভিযানে দুই পাক সেনাসহ প্রায় ৩৮ জঙ্গি মারা যায়।