১৪-দলীয় নামে পরিচিত হলেও এ জোট ১৪ দল নিয়ে হয়নি, জোটে আছে ১৩ দল। বলা চলে, ১৪-দলীয় জোটে আওয়ামী লীগই ষোল আনা। নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় ১২টি দলই আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল। জোটের বাইরে দৃশ্যমান কর্মসূচিও নেই শরিকদের। ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ ও ‘ক্ষমতা ভোগ’ সবকিছুতেই এগিয়ে জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জোটের কেন্দ্রে ঐক্য থাকলেও চরম সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে তৃণমূলে। আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের ‘একলা চলো নীতিতে’ জোটের শরিকদের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব বেড়ে চলেছে। কেন্দ্রে নিয়মিত মিটিং, মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও তৃণমূলে উল্টো। মাঠপর্যায়ে শুধু ‘ক্রাইসিসে’র সময় জোটের শরিকদের ডাকা হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ অন্য কিছুতে এক কাতারে আসতে পারেন না জোটের নেতারা। রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহসহ প্রায় ৩০টি জেলা-উপজেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে অনৈক্যের চিত্র পাওয়া গেছে।
বর্তমানে ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ (ইনু), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ (আম্বিয়া), জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি—ন্যাপ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল—বাসদ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন। এসব রাজনৈতিক দলের শুধু জেলাই নয়, বেশ কয়েকটির কেন্দ্রীয় অফিসেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। নেই জেলায় জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম। তবে যেসব শরিক দলের দলীয় কার্যক্রম আছে, সেগুলোর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় নেই আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের। আবার কোথাও শরিক দলের নেতাদের ‘প্রত্যাশা’ বেশি থাকায় তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে চান না আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে দিন দিন দূরত্ব বেড়েই চলেছে। জোটের শরিকরা যত কথাই বলুক না কেন, শুধু কেন্দ্রে নয়, কেন্দ্রের বাইরেও তৃণমূলে স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী তারা। উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গ না পেয়ে ভোটে অনেকটাই কোণঠাসা তারা। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও বাম দলের প্রার্থীরা মুখ খুলতে পারেননি। বিএনপি-জামায়াত মোকাবিলায় অনেকেই আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলতেও বাধ্য হয়েছেন।
জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক অফিসে ১৪ দলের প্রায় নিয়মিত বৈঠক হয়। বিভিন্ন ইস্যুতে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশও করা হয়। সম্প্রতি জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মসূচিতে যোগ দিলেই কেবল শরিকদের ডাকা হয় বলে অভিযোগ শরিকদের। কেন্দ্র দলগতভাবে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ মেলাতে পারলেও ক্ষোভ রয়েছে শরিক দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৪ দলের নেতাদের ঐক্য ধরে রেখেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সম্প্রতি এক বৈঠকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে জোটের ঐক্য সুদৃঢ়। ঐক্যবদ্ধভাবেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ১৪ দল সব সময় মাঠে ছিল, আগামীতেও থাকবে। জোটের ঐক্য অটুট আছে, অটুট থাকবে। তবে জোটের সমন্বয়কের কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না তৃণমূলে। কিছু জেলায় আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের একলা চলো নীতিতে নাখোশ জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা। আবার কিছু জেলায় শরিকদের মধ্যে বোঝাপড়া খুবই ভালো। খুলনায়ও সমন্বয় নেই কেন্দ্রীয় ১৪ দলের। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বোঝাপড়া নেই শরিকদের। বিগত জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে জোটগত প্রার্থী দিতে পারেনি ১৪ দল। কাগজে-কলমে কমিটি থাকলেও দীর্ঘদিনেও এক টেবিলে বসতে পারেননি জোটের নেতারা। জোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও খুলনা বিভাগে দলের দায়িত্বে থাকা শরীফ শফিকুল হামিদ চন্দন বলেন, খুলনায় মাঠপর্যায়ে জোটের তেমন কার্যক্রমই নেই। শুধু ‘ক্রাইসিসে’র সময় জোটের শরিকদের ডাকা হয়। কিন্তু ক্ষমতার সব সুবিধা নেয় আওয়ামী লীগ। শরিকরা বঞ্চিতই থাকছে। তবে এ কথা মানতে নারাজ ১৪-দলীয় জোটের খুলনার সমন্বয়ক মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান এমপি। তিনি বলেন, জোট আগের মতোই সক্রিয়। সাংগঠনিক অবস্থাও ভালো। আগামী নির্বাচনে ভোটের মাঠে জোট তার সাবেক ভূমিকা পালন করবে। জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো নীতিতে’ নাখোশ সিলেটের শরিক দলের নেতারা। প্রায় এক বছর আগে জোটের সমন্বয়ক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ানের মৃত্যুর পর নতুন সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এর জন্য আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেই দায়ী করছেন শরিকরা। তবে সিলেট জেলা সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, সিলেটে ১৪-দলীয় জোটের কার্যক্রম রয়েছে। কেন্দ্র থেকে যত কর্মসূচি আসে, তা জোটগতভাবে পালন করা হয়। এ জোটে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান আহমদ বলেন, সম্প্রতি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী একটি মানববন্ধন ছাড়া সিলেটে দীর্ঘদিন ১৪ দলের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়া কখনো একসঙ্গে বসা হয় না ১৪ দলের নেতাদের। সিলেট জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সিকন্দর আলী বলেন, সিলেটে ১৪-দলীয় জোটের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। নিয়মিত কোনো কর্মসূচিও নেই। আওয়ামী লীগের নিজস্ব সমস্যায় জোট অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। নামে ১৪ দল হলেও সিলেটে এ জোটের চার-পাঁচটি ছাড়া বাকি দলগুলোর অস্তিত্ব বোঝা দায়। আওয়ামী লীগ ছাড়া জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টির মাঝেমধ্যে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও অন্যদের খবর নেই। রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়হীনতা ও শরিক দলের নেতাদের মূল্যায়ন না করায় অসন্তোষ বিরাজ করছে ১৪ দলে। শরিক দলের নেতারা বলছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করেন শরিক দলের নেতা-কর্মীরা আর মধু খান আওয়ামী লীগ নেতারা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলছেন, এটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সরকার গঠন করার পর থেকে এখন পর্যন্ত রংপুরে জোটের মাত্র তিনটি সভা হয়েছে। শরিক দলের নেতাদের সঙ্গেও সমন্বয় নেই আওয়ামী লীগ নেতাদের। জোটের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালনের বেলায় কেবল শরিকদের ডাক পড়ে। বিগত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জোটগতভাবে প্রার্থী দিতে পারেনি ১৪ দল। ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় কমিটি যখন কর্মসূচি দেয় তখনই রংপুর কমিটি একটু নড়েচড়ে বসে। ১৪ দলের জেলা সমন্বয়ক ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জেলা পরিষদ প্রশাসক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৪ দলের মধ্যে ১০ দলেরই অস্তিত্ব নেই রংপুরে। জোটের কর্মসূচিতে ডাকলে শরিকরা আসে, না ডাকলে আসে না। তাদের আগ্রহ নেই। তারা জামাই আদর খোঁজে। এভাবে তো চলে না। দেশপ্রেম থাকতে হবে। হসময়মনসিংহে ১৪-দলীয় জোটে ঐক্য থাকলেও এ জোটটিই মূলত অস্তিত্বহীন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন এ জোটে জাসদ আর ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলোকে রাজপথে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। রাজশাহীতে জোটের রাজনীতি বাস্তবে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। ফলে আগামীতে জোট ও ভোটের রাজনীতিতে ১৪ দল সংকটে পড়বে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতারা। ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে শীতল সম্পর্কের কারণে জোটের রাজনীতিতে ঐক্যের বদলে ‘একলা চলো নীতি’ প্রাধান্য পাচ্ছে। ১৪ দলের নিয়মিত বৈঠকও হয় না। নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা জানান, ১৪ দল মূলত কার্যকর নয়। নামেই আছে সেই কমিটি। কার জন্য বা কেন ১৪ দল কার্যকর নয়, সে প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। যশোরে জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা অভিযোগ করছেন, কেন্দ্র থেকে বার বার বলা হলেও এখানে কোনো সমন্বয় করা হয় না। বিভিন্ন ইস্যুতে শরিক দলগুলো পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে যশোর জেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘জোটগতভাবে আমরা যশোরে সক্রিয় আছি, একসঙ্গে রাজপথে আছি। সাম্প্রতিককালে জঙ্গিবাদবিরোধী ইস্যুতে আমরা যশোর শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি পালন করেছি, যেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।’ জেলা জাসদ সভাপতি রবিউল আলম বলেন, মহাজোট সরকার গঠনের পর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল থেকে মন্ত্রী করা হলো। এরপর ঢাকায় জোটের মিটিং হয়। জেলা পর্যায়েও জোটের সমন্বয় মিটিং করার জন্য কেন্দ্র থেকে বার বার বলা হলেও প্রথম দিকে দু-তিনটি মিটিং ছাড়া কার্যকর কোনো সমন্বয়ই হয়নি। স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারেও শরিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ কোনো আলোচনা করেনি।