শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন

মন্দিরে হামলা পূর্বপরিকল্পিত, দায় আছে পুলিশেরও

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা এবং ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ব্যর্থতা এবং অদক্ষতার কারণে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তাদের দূরদর্শিতার অভাব, উদাসীনতা এবং অবহেলা এ হামলার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা এ দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। হামলাকারীরা পূর্বপরিকল্পনামতো এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা অতীতেও এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। গতকাল রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেসে কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন তিনি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে হামলার বিস্তারিত তুলে ধরা হয় এ সংবাদ সম্মেলনে। এর আগে বুধবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পরিদর্শন করে। দলের সদস্যরা হামলার শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে প্রতিনিধি দলটি একটি তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সমাবেশের অনুমতি দিলেও প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রাখায় এ হামলা ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং নাসিরনগর উপজেলার পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের অদূরদর্শিতার বিষয়ে তদন্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নিতে বলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সন্দেহভাজন অপরাধীরা যে রাজনৈতিক দলের সদস্যই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে রবিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত নাসিরনগরে ১৫টি মন্দিরসহ হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। একই সঙ্গে পাশের জেলা হবিগঞ্জের মাধবপুরেও দুটি মন্দিরে হামলা হয়।

পাঁচ দিনের রিমান্ডে রসরাজ ভাঙচুর ঘটনায় গ্রেফতার ১১ : কাবা শরিফের ছবি ব্যঙ্গ করে মহাদেবের মূর্তি বসিয়ে দেওয়ার ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার রসরাজ দাসের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এদিকে নাসিরনগরের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর ঘটনায় আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হলো। এদের ভাঙচুর মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহর ও শহরতলির মসজিদ, মাদ্রাসায় দুর্বৃত্তরা তালা মেরে কাবা শরিফের বিকৃত ছবি সাঁটিয়ে দেওয়ায় নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় বিশিষ্ট আলেমদের নিয়ে তাত্ক্ষণিক সভা করেছেন। জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার রসরাজ দাসকে গতকাল কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার সাত দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন। আদালত পাঁচ দিন মঞ্জুর করে। এদিকে ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দফতর থেকে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শাখাওয়াত হোসেনকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। গতকাল সকালে কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তাদের সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২৯ অক্টোবর রসরাজ দাস তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কাবা শরিফের ওপর শিবমূর্তি বসিয়ে একটি ছবি পোস্ট করেন। এ ঘটনায় উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় শনিবার দুপুরেই রসরাজকে আটক করে নাসিরনগর থানা পুলিশ।

নতুন করে উত্তেজনা : নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। শহর ও শহরতলির মসজিদ, মাদ্রাসায় দুর্বৃত্তরা তালা মেরে কাবা শরিফের বিকৃত ছবি সাঁটিয়ে দেওয়ায় এ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় বিশিষ্ট আলেমদের নিয়ে তাত্ক্ষণিক সভা করেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, দুর্বৃত্তদের ধরতে অভিযান চালানো হয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, বুধবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর সিরাজুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত শহরের ভাদুঘরে জামিয়া সিরাজিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান ফটকে দুটি তালা মেরে দেয় দুর্বৃত্তরা।

 সেই সঙ্গে কাবা শরিফের ছবির ওপর মূর্তি বসিয়ে বিরাট পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। ভোরে মাদ্রাসার ছাত্ররা এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একইভাবে শহরের কাউতলী জামে মসজিদ ও শহরতলির বিজেশ্বরে জামিয়াতুস সুন্নাহ মাদ্রাসায় একই কায়দায় পোস্টার সাঁটানো হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জেলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘটনাটি জানায়। সদর থানা পুলিশ খবর পেয়ে মাদ্রাসায় পৌঁছে তালা ভেঙে গেট খুলে দেয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে বেলা ১১টায় জেলার শীর্ষ আলেমদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমানের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন, মুফতি মোবারক উল্লাহ, মাওলানা মনিরুজ্জামান সিরাজী, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা ইদ্রিস প্রমুখ। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈনুর রহমান জানান, জেলা ও আশপাশ জেলার বিভিন্ন প্রেসে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে পোস্টার প্রিন্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

জাসদের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল সকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার এমপি জাসদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে দুপুরে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে শিরিন আখতার বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর