শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চামড়াজাত পণ্য বিশ্ববাজারে

রুহুল আমিন রাসেল

চামড়াজাত পণ্য বিশ্ববাজারে

শুধু কাঁচা চামড়াই নয়, এবার প্রক্রিয়াজাত চামড়ায় তৈরি পণ্য রপ্তানিতে অধিক নজর দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশি চামড়া উন্নত মানের হওয়ায় বিশ্ববাজারে সম্ভাবনাও বিশাল। তারই চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রপ্তানিতে। দেশীয় চামড়াশিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর হলো— সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের জুতাশিল্পকে আগামী পাঁচ বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব চামড়ার কদর থাকায় ব্যবসায়ীদের আশাবাদ— হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানা পুরোপুরি সাভারে গেলে চামড়াশিল্পে বিপ্লব ঘটে যাবে। এ প্রসঙ্গে ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা—সিইও মাফরুহা সুলতানা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চামড়ার ক্ষেত্রে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো— দেশে যে কাঁচামাল আছে, তা আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারি না। রপ্তানিতে সমস্যা আছে। সেন্ট্রাল ইটিপি কাজ শেষ হয়নি। হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তর হলে সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। তবে ২০২১ সালে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চামড়া রপ্তানির টার্গেট আছে। এক্ষেত্রে কাঁচা চামড়া রপ্তানির চেয়ে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বেশি নজর দিয়েছি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, অর্থনীতিতে চামড়াশিল্পের অবদান দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়ার তৈরি জুতাসহ বিভিন্ন রকমের পণ্য রপ্তানি বাড়ছে। এ শিল্পের অধীনে আছে ২২০টি ট্যানারি। অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও দর্শনীয় সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। সরাসরি এই শিল্পে কর্মরত আছেন প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মচারী। মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি—জিডিপিতে চামড়াশিল্পের অবদান শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ইপিবির তথ্যে দেখা গেছে, গত তিন বছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৩৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ১২৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এই হিসাবে মাত্র তিন বছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২২৫ শতাংশ। ইপিবির তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাড়লেও অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। এই সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে। আর চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৯ কোটি ২৫ লাখ মার্কিন ডলার, যা এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ কম। হঠাৎ চামড়াপণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়াকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন—বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশি চামড়া উন্নত মানের হওয়ায় বিশ্ববাজারে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তারই চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রপ্তানিতে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চামড়া রপ্তানি করেছি। পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব চামড়া রপ্তানি করতে পারলে এটা আরও বাড়বে। আর ট্যানারিশিল্প সাভারে পুরোপুরি স্থানান্তরের পর এই শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। তবে সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ। সাভারের ট্যানারিপল্লীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না। সরকার ক্ষতিপূরণের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দিতেও ধীরগতি করছে বলে অভিযোগ এই ব্যবসায়ী নেতার। জানা গেছে, চীনের বাণিজ্যনীতির পরিবর্তনের ফলে এখন বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। চীনের ছেড়ে দেওয়া বিশ্বের জুতার বাজারের ওই অংশটিই ধরতে চাইছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন—এলএফের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১১০টি রপ্তানিমুখী কারখানায় চামড়ার জুতা  তৈরি হয়। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি। বাংলাদেশে জুতার চাহিদা কত- তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। তবে বাজারের অভিজ্ঞতা থেকে এই খাতের ব্যবসায়ীদের ধারণা, দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ কোটি (২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন) জুতার চাহিদা রয়েছে। যার ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন থেকে পূরণ হয়। তবে বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে ভারত, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, হাইতি ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন—বিটিএর তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া উৎপাদিত হয়। জুতা ও অন্যান্য পণ্য তৈরিতে সেই চামড়ার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহূত হয়।  জুতার বিশ্ববাজার বিশ্লেষণ বলছে, ব্যবহারকারীদের ৫৫-৬০ শতাংশই সিনথেটিকের জুতা পরেন। এ বিষয়টিও মাথায় এনে বাংলাদেশি কারখানার মালিকরা সিনথেটিক জুতা তৈরিতে বেশি নজর দিয়েছেন। ইপিবি তথ্যও বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জুতা রপ্তানির পরিমাণ ৭১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরেও এই পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চামড়াশিল্পের তিন সংগঠন- বিটিএ, বিএইচএসএমএ ও বিএফএলএলএফইএ তথ্যমতে, বাংলাদেশি চামড়ার মান ভালো হওয়ায় বিশ্ববাজারে চাহিদাও বেশি। সস্তা শ্রম ও নিজস্ব চামড়ার কারণে দেশে তৈরি চামড়ার পণ্যও অল্প দিনেই বিদেশি ক্রেতাদের নজর কাড়ে। বাংলাদেশি চামড়াপণ্যের মধ্যে ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান আছে জুতা পণ্য। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ব্র্যান্ডের জুতার শোরুমেও আছে বাংলাদেশের তৈরি জুতা। শুধু চামড়ারই নয়, রয়েছে সিনথেটিক জুতাও। দেশের কারখানাগুলোয় বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর জুতা তৈরি হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে রপ্তানি। রপ্তানির শীর্ষ দশে আছে জুতা। বিশ্ব জুতাশিল্পে শিগগিরই নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ।  এদিকে এইচঅ্যান্ডএম ও নোভির মতো ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করে ফরচুনা ফুটওয়্যার। চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেডে ইয়াঙ্গুনের কারখানায় তৈরি হচ্ছে টিম্বারল্যান্ড, পুমা, ডেকাতেলান, নর্থ ফেস ও পাটাগোনিয়া ব্র্যান্ডের জুতা। বিডটজেডডট মোডা, হিউম্যানিক, রিগ্যালের ব্র্যান্ডের জন্য জুতা তৈরি করছে লেদারেক্স। এর সঙ্গে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে— বে, এবিসি, আকিজ, অ্যালায়েন্স, হ্যামকো, জেনিস, লালমাই, ফরচুনা, ম্যাফ, পতেঙ্গা, রিমেক্স, রয়্যাল, স্কারপি ই মোদা, সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রি, পিকার্ড ও বিএজি ফুটওয়্যার অন্যতম। এফবি ফুটওয়্যারে তৈরি হচ্ছে এনা, অ্যারোমা, টোকার্স, এইচঅ্যান্ডএম, তামারিজসহ আরও কয়েকটি নামি ব্র্যান্ডের জুতা।

সর্বশেষ খবর