সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হিলারি প্রথম নন হিলারিই প্রথম

শামীম আল আমিন, নিউইয়র্ক থেকে

হিলারি প্রথম নন হিলারিই প্রথম

ইতিহাসের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখলে অজানা অনেক কিছু সামনে এসে ধরা দেয়। যার সবই একটা সময় ছিল, ‘বর্তমান’। আবার বর্তমানে অনেকে এমন কিছু কাজ করছেন কিংবা এমন কোনো স্বীকৃতি অর্জন করছেন, যা ভবিষ্যতে ইতিহাস হয়ে যাবে। তেমনি একটি ইতিহাস গড়েছেন হিলারি ক্লিনটন। হ্যাঁ, ইতিহাস তিনি গড়েছেন বটে। তবে সার্বিক বিচারে তিনিই প্রথম নন। আবার ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে, তিনিই প্রথম। ফলে আলোচনায় তিনি সব সময়ই থাকবেন। আর যদি শেষ পর্যন্ত তিনি বিজয়ী হন, তাহলে যা ঘটবে তাকে আমি বলব ‘মহা ইতিহাস’। এবার একটু খোলাসা করেই আলোচনাটা করা যাক। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে হিলারি ক্লিনটনই প্রথম কোনো নারী হিসেবে বড় একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। বর্তমানে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে এই মনোনয়ন পেয়ে নিশ্চিতভাবেই তিনি ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট পদে নারী প্রার্থী হিসেবে তিনিই প্রথম নন। ছোট একটি দলের হয়ে প্রায় দেড়’শ বছর আগে এই পদে প্রার্থী হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া ক্ল্যাফলিন উডহল। পরবর্তীকালে যার নাম হয়েছিল ভিক্টোরিয়া উডহল মার্টিন। যিনি ছিলেন মূলত আমেরিকান নারীর ভোটাধিকার আদায়ের এক নেতা। তিনিই প্রথম কোনো নারী হিসেবে ১৮৭২ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছিলেন। ইকুয়াল রাইটস পার্টি থেকে তিনি এই মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই তার প্রার্থিতার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তবে কেউ কেউ অবশ্য তার প্রার্থিতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। বিশেষ করে বয়সজনিত কারণ দেখিয়ে। কারণ হিসেবে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে কমপক্ষে ৩৫ বছর প্রয়োজন হয়। যখন তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন, তখন তার বয়স প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। কিন্তু সমসাময়িক পত্রিকাগুলোর মতে, তিনিই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। আর এ ক্ষেত্রে বয়স সমস্যা ছিল না। ভিক্টোরিয়া উডহলের জন্ম ১৮৩৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ওহায়ো’র হোমারে। তিনি ছিলেন নারী অধিকার কর্মী। আগেই বলেছি, নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে থাকা একজন। ছিলেন রাজনীতিবিদ। যদিও তার আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। তবুও মেধা-মননে তিনি ছিলেন অগ্রণী একজন। শেষ জীবনে তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করেছিলেন। পরে ৮৮ বছর বয়সে ১৯২৭ সালের ৯ জুন তিনি ওরচেস্টারশায়ারের ব্রেডনে মারা যান। এবার আসা যাক, হিলারি ক্লিনটনের কথায়। আগেই বলেছি, তিনি প্রথম নন। আবার তিনিই প্রথম। আর তা বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে। চলতি বছরের জুলাই মাসে পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার ওয়েলস ফার্গো কনফারেন্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশন থেকে তিনি এই মনোনয়ন পান। এই জাতীয় কনভেনশনে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ‘রোল কল’ ভোট গণনা শেষে হিলারিকে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দেওয়া হয়। কনভেনশনের আগে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রাইমারি ভোট ও ককাসে হিলারির সঙ্গে বার্নি স্যান্ডার্সের লড়াইটা বেশ জমে উঠেছিল। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়ে স্যান্ডার্স বেশ চমক দেখালেও শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির সমর্থন যায় হিলারির পক্ষে। ডেমোক্রেটিক সম্মেলনে হিলারিকে ৪ হাজার ৭৬৫ ডেলিগেট ভোট দেন। দলের মনোনয়ন পেতে ২ হাজার ৩৮৩ ডেলিগেটের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। সম্মেলনের আগেই প্রাথমিক নির্বাচনে প্রয়োজনীয় ডেলিগেটের সমর্থন জোগাড় করেন হিলারি। তিনি ২ হাজার ৮০৭ ডেলিগেটের সমর্থন পেয়েছেন। এর মধ্যে ৬০২ জন সুপার ডেলিগেট। অন্যদিকে মনোনয়ন দৌড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকা বার্নি স্যান্ডার্সের ঝুলিতে ছিল ১ হাজার ৮৯৪ ডেলিগেটের সমর্থন। তাই সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন পাওয়া ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। পরে সমর্থকদের আপত্তির মুখেও হিলারিকে সমর্থন দিয়ে বার্নি স্যান্ডার্স যা কিছু সংশয় ছিল তা দূরে করে দেন। আট বছর আগে, ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নারীদের সামনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাচের দেয়ালের কথা বলেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এবার মনোনয়ন নিশ্চিত করায়, সেই কাচের দেয়ালটিতে ১৮ মিলিয়ন ভাঙা টুকরো। সেবার ১৮ মিলিয়ন ভোট পাওয়ার পরও, বারাক ওবামার কাছে হারতে হয়েছিল তাকে। শেষ পর্যন্ত ওবামাকে সমর্থন জানিয়ে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ইতিহাস গড়ার জন্য অনেকটাই দীর্ঘায়িত হয়েছিল, তার পথটা। মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পরে হিলারি ক্লিনটন সেদিন এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমরা কাচের দেয়ালে সবচেয়ে বড় ফাটল তৈরি করতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনো ছোট মেয়ে এই ভিডিওটি না দেখে থাকে তাহলে তার উদ্দেশে আমি বলতে চাই, আমি হয়তো আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবো কিন্তু তোমাদের মধ্যেই কেউ একজনই হবে আগামী দিনের প্রেসিডেন্ট।’ ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন একজন রাজনীতিবিদ। তার জন্ম ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগো শহরে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। ব্যক্তিগত জীবনে সফল একজন মানুষ তিনি। তার স্বামী বিল ক্লিনটন পর পর দুবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। হিলারি ছিলেন ফার্স্টলেডি। কেবল স্বামীর পরিচয়ে তিনি পরিচিত হননি। প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থিতা ছেড়ে দিয়ে পরে দেশের ৬৭তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিউইয়র্ক স্টেটের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সিনেটরও ছিলেন। রাজনীতিতে আসার আগে হিলারি নিয়োজিত ছিলেন আইন পেশায়। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সবাই পুরুষ। এমনকি প্রধান দুটি দল কখনো নারীদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নই দেয়নি। ডেমোক্রেটিক দলের সম্মেলনে হিলারিকে সমর্থন জানান সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডারসহ অনেক শীর্ষ নেতা। হিলারিকে সাধুবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠান সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও। জর্জ বুশ হিলারিকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। আরও অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন হিলারির প্রতি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হিলারির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে তার এবং হিলারির স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের চেয়েও যোগ্য বলেছেন হিলারিকে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো হিলারির পেছনে একাট্টা। বিভিন্ন সময়ে করা জনমত জরিপে এগিয়ে থাকছেন তিনি। তাহলে দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে এবার চূড়ান্ত ইতিহাস গড়ার কথা তো ভাবতেই পারেন হিলারি ক্লিনটন! লেখক : লেখক ও সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর