সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
৭ নভেম্বরের অজানা কাহিনী

জাসদের ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ প্রয়াস

এ বি তাজুল ইসলাম

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল প্রকৃতপক্ষে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ড ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র  প্রতিবাদ। চারটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে দুটিতে সফলতা অর্জন করেছিলাম। আর দুটিতে আমরা পারিনি। সফলতা দুটি হলো— অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী বিদ্রোহীদের বলপূর্বক অপসারণ করা এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোকে চেইন অব কমান্ডে ফিরিয়ে আনা। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি কোনো পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল না। মোশতাক, রশিদ, ফারুক চক্র এই পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়নি। জিয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে জাসদ ও কর্নেল তাহেরই ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালায় ৭ নভেম্বর। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় বিপ্লবী রাজনীতি ছিল না। সৈনিক সংস্থার ১২ দফা বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল না। সামরিক ছাউনির অভ্যন্তরে ঘৃণা আর হিংসা বিদ্বেষে ভরপুর। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো দাবি ছিল না। ৩ নভেম্বর ভোর থেকেই শুরু হয় ১৫ আগস্ট হত্যাকারী বিদ্রোহী অফিসারদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে বাগ্যুদ্ধ। দুপুরের কিছু পর ৪-৫ জনের একটি নেগেসিয়েশন টিম আমাদের পক্ষ থেকে পাঠানো হয় বঙ্গভবনে। খুনিরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সংঘাতের পথ বেছে নেয়। প্রথমে বড় বড় কথা বললেও সারাদিন হেলিকপ্টার ও মিগের মহড়া দেখে তারা বিচলিত হন। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মোশতাকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজের অঙ্গীকার দাবি করেন। ৩ নভেম্বর রাতেই ঘটে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়। আমরা বিষয়টি জানতে পারিনি। ৪ নভেম্বর সকালে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গলের হেড কোয়ার্টারে আসেন। প্রথমে তাদের মুখেই এই হত্যাকাণ্ডের কথা শুনি। বেলা ১১টার দিকে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে যান। সেখানে মোশতাক ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা অবস্থান করছিল। ওই দিন আমাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হচ্ছিল মোশতাককে সরিয়ে কাকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হবে? ৪ তারিখে মোশতাককে গৃহবন্দী করা হয়। ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ৬ নভেম্বর দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সায়েমের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। দুপুর থেকেই বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিভিন্ন জায়গার ট্যাংকগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আনা হয়। সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সব ট্যাংক তাদের ইউনিট লাইনে চলে আসে। বিকাল থেকেই খবর পাই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নামে উসকানিমূলক লিফলেট ছড়ানো হয়েছে। এই সংগঠন সম্পর্কে সেদিনই প্রথম জানতে পারি। শুনতে পাই ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অফিসারদের বিরুদ্ধে নানা কথাবার্তা চলছে তাদের। সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ সৈনিকদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে সন্ধ্যার দিকে ট্যাংক রেজিমেন্টে গেলেন। সেখানে সৈনিকদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন তিনি। ট্যাংক থেকে ফিরে সেনা সদরে বৈঠক করলেন খালেদ মোশাররফ। সৈনিকদের সব অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা দিতে বললেন তিনি। রাত ১১টার দিকে জানতে পারি জাসদ ও সৈনিক সংস্থার আহ্বানে সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। টার্গেট ছিল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলকে হত্যা করা। সেদিন আমি ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। এর মধ্যে ঘটে যায় ‘সিপাহি বিপ্লব’। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বঙ্গভবনের অদূরে ‘নারায়ে তাকবির, সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই স্লোগান দেয়। চলে ফাঁকা গুলিও। সেদিন অফিসারদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ উসকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে অফিসার নিধনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে তারা সৈনিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে এনে ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছিল। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে জিয়া ও তার অনুগতরা জাসদ ও তাহেরের ওই অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। জাসদ তাদের লক্ষ্য অর্জনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু জাসদ ও তাহেরের হঠকারিতায় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনানীদের বেশ কয়েকজন নিহত হন। ৭ নভেম্বরের ঘটনা জাসদ যত বিপ্লবী তত্ত্বই দিক না কেন মূলত রাজনীতি বর্জিত ক্ষমতা দখলের একটা নির্লজ্জ প্রয়াসমাত্র। আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিলাম দুটি বিষয়ে সফল হলেও আর দুটিতে পারিনি নানা কারণে। অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর