বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সরকার তৈরি করছে ইস্যু

প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় । জেনেশুনে সাঁওতাল এজেন্ডা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে । দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে খুনোখুনি বাড়ছে । কারণে-অকারণে বিতর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিরোধী দলের আন্দোলন না থাকলেও সরকার নিজেই সমস্যা তৈরি করছে। কঠোর হস্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুর ও আগুনের ইস্যুটি শুরুতেই দমন না করায় সেটি ছাড়িয়েছে দেশের সীমা। গড়িয়েছে এখন দিল্লি পর্যন্ত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এই ইস্যুতে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল নির্যাতনের ইস্যুটিও এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। উন্নয়নের গতি যখন ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছুঁয়েছে রেকর্ড, ঠিক তখনই অকারণে ইস্যু তৈরি হচ্ছে দেশে। এতে বিব্রত হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ইমেজ। তবুও এসব নিয়ে সরকারি দলের নির্বিকার মনোভাব। বিস্মিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদেরও। জানা যায়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাকে চরম ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে হামলার ঘটনায় অভিযোগের তীরও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দিকেই। এ নিয়ে অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সরকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে অন্তর্কোন্দলে ৫২ জন নিহত হয়েছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। আহত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার। আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্য দলের সংঘর্ষে খুন হয়েছেন ১১ জন। আহত প্রায় ৪৫০ জনের মতো। জানা যায়, হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অন্তর্কোন্দল বেড়ে গেছে। জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব যখন জেলা সফর করে সংগঠনকে আরও গতিশীল করতে উদ্যোগী তখন হঠাৎ মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সুযোগ সন্ধানীদের তত্পরতাসহ নানামুখী সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এদিকে প্রায় দেড় ডজন এমপি ও তাদের আত্মীয়স্বজন-ক্যাডার বাহিনীর নানা অপকর্মে বিব্রত শাসক দল। এমনকি তাদের অনেকের অতিকথনেও কখনো কখনো অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। অকারণেই তারা একের পর এক ইস্যু তৈরি করছে। বাংলাদেশ যখন সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, ঠিক তখনই এসব এমপির এমন কর্মকাণ্ডে এ অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিচ্ছে। এতে ক্ষমতসীনদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় সরকার বিব্রত হয়েছে কি না জানি না, সেখানে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু সংখ্যালঘু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটাই সত্য। এ সরকারের গত তিন বছরে ক্রমাগতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তাতে সরকারের মন্ত্রীরা যতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলুক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। এ বিষয়গুলো আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সরকারকেও বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এসব ঘটনায় জড়িত যারাই থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় অবশ্যই জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সেখানে যদি সরকার সমর্থকরাও থাকে, তাহলেও তাদের বিচারের মুখোমুখি করা জরুরি। বিশ্বে যখন বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছেই, ঠিক তখনই এসব ঘটনা সরকারের জন্য অবশ্যই বিব্রতকর। উন্নয়নের বাধা সৃষ্টি করছে। কিন্তু এই সুযোগে কেউ উগ্রবাদকে উসকে দেয় কি না তা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের এখন শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, মৌলিক মূল্যবোধকে আরও জাগ্রত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এসব ঘটনায় আমরা লজ্জিত। দেশের ভিতরেই সাধারণ মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে। শান্তিপ্রিয় একটি জাতি, যাদের আদিবাসী বলে ডাকার অধিকারও আমরা খর্ব করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমরা চড়াও হয়েছি। তারা তাদের জন্মভিটার দাবিতে আন্দোলন করছে। এ জন্যই আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তাহলে মানুষের প্রতি কেন আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করছি। তারা অরক্ষিত। তাদের হাতকড়া পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে রেখেছি। পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। তাদের চিকিৎসা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলে পাঠাচ্ছি। যেখানে ক্ষমতাসীনদের প্রচুর মানুষ অপরাধ করে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের পুলিশ ছুঁতে পারে না। তাদের ধরতে পারে না। জেলে গেলেও তাদের বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেখানে এসব ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপার।

তিনি বলেন, এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তো কথাই নেই। সরকারের বিব্রত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, সরকারকে বিব্রত হওয়ার জন্য মানুষ ভোট দেয় না। সরকারকে ভোট দেওয়া হয়, ন্যায়ের পক্ষ থেকে জনগণের সেবা করার জন্য। সেখানে যদি সরকারের নিজের লোকজন জড়িত থাকে তাহলে সরকার বিব্রত না হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে হবে। তাদের ধরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এটাই সরকারের কাজ। এ জন্যই তাদের ভোট দেওয়া হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা শুধু সরকারের জন্যই নয়, দেশের ওপরই আঘাত। এসব ঘটনা শুধু নিন্দনীয় নয়, দুঃখজনকও বটে। দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তির বিষয়টিও জড়িত। সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। জড়িত যারাই থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব ঘটনায় শুধু সংখ্যালঘুরাই নন, আমি মনে করি, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, সাম্প্রতিক সব ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন যথাযথভাবে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বিষয়টিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়ার পরেও মাঠপর্যায়ের পদক্ষেপ আশাব্যঞ্জক ছিল না। সামগ্রিকভাবে সরকারের দিকেই ব্যর্থতার অভিযোগ আসা সঙ্গত। তবে প্রশাসনিক ব্যর্থতা অবশ্যই আমলে নেওয়ার মতো। যা গুরুতর।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর