ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে নির্ঝঞ্ঝাট ও উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের মূল গবেষণা বা সমীক্ষা। বাংলাদেশে অবস্থান করে ৬৫ জাপানি প্রকৌশলী ঢাকার কাছাকাছি স্থান চূড়ান্ত করার কাজ করছেন। চুক্তি মোতাবেক জাপানিজ কনসালট্যান্ট ফার্ম নিপ্পন কোই কো লিমিটেড ১২০ কোটি টাকার সমীক্ষা শুরু করেছে বেশ জোরেশোরে। লাগবে দেড় বছর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরুই বড় অর্জন। টার্গেট ২০১৮ সালে মূল কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। যথাযথ সময়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কাজ শুরু করতে পারলে আর মাত্র এক দশকের মধ্যে অত্যাধুনিক এ বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকেই আন্তর্জাতিক রুটে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো আকাশে ডানা মেলতে পারবে। বাংলাদেশ ঘোচাতে পারবে বিমানবন্দরে ভোগান্তির কালিমা। প্রবেশ করতে পারবে অত্যাধুনিক এয়ারপোর্টের এলিট ক্লাবে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ—বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাপানের নিপ্পন কোম্পানি উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য যে ধরনের তথ্য প্রয়োজন তা সংগ্রহের কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে যে স্থানগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে এর বাইরে আরও কোনো উপযুক্ত স্থান আছে কি না তাও যাচাই-বাছাই করবে এই সমীক্ষা দল। ব্যাংকক, দুবাই, সিঙ্গাপুরের মতো আধুনিক বিমানবন্দরের সুবিধা সংবলিত একটি হাব পর্যায়ের বিমানবন্দর তৈরির স্বপ্ন আছে আমাদের।’
বেবিচকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বিমানবন্দরটি নির্মাণের জন্য বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের ফিজিবিলিটি স্টাডি সেল গঠন করা হয়। সর্বশেষ মাদারীপুরের চর জানাজাত, মুন্সীগঞ্জের কেয়াইন ও লতব্দী, ঢাকার কাছের চরবিলাশপুরের জমি—এই তিনটি স্থান বিমানবন্দরটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে সমীক্ষার জন্য ঠিক করা হয়েছে। পাশাপাশি নিপ্পনের সমীক্ষা দল যদি আরও উপযুক্ত কোনো স্থান খুঁজে বের করে, সেটিকেও প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহকে দেওয়া হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। আর সমীক্ষা দল স্থান নির্বাচনে বেশ কয়েকটি বিষয় দেখবে। এর মধ্যে জমির মূল্য ও জমি-সংক্রান্ত ঝুঁকি, এর আর্থিক প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। সমীক্ষার জন্য নির্ধারিত ১২০ কোটি টাকার পুরো অর্থ সরকার ব্যয় করছে। আর সংশ্লিষ্টরা আপাতত ধারণা করছেন, বিমানবন্দরটি নির্মাণে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এটি নির্মাণে আট হাজার একর জমি প্রয়োজন হতে পারে এবং সময় লাগতে পারে ১০ বছর। এমনটাই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। মূলত নিপ্পনের সমীক্ষা দলটি নির্মাণব্যয়, সময়সীমা ও এর মডেল কেমন হবে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে। আগামী ১০০ বছরে দেশের সম্ভাব্য জনসংখ্যা, যাত্রী পরিসংখ্যান, যাতায়াত ব্যবস্থা, যাতায়াত অবকাঠামো ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বিমানবন্দরের মডেল তৈরি করা হবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে জানা যায়, পাবলিক ও প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প বা পিপিপির অধীনে নির্মেয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ তদারক করবে বেবিচক। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, অগ্রাধিকারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। ইতিমধ্যে নির্ধারিত আছে প্রায় ১৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। সরকার চলতি বছরের শুরুতে জাপানিজ কনসালট্যান্ট ফার্ম নিপ্পন কোই কো লিমিটেডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সমীক্ষার চুক্তি করে। সে অনুসারে ৬৫ সদস্যের সমীক্ষা দল স্থান নির্বাচন শুরু করেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন হাতে পাওয়া মাত্র নকশা ও অবকাঠামোগত স্থাপনার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। তাদের মতে, বিমানবন্দরটি নির্মাণের জন্য মূল গবেষণার কাজ শুরু করাই একটি ইতিবাচক বিষয়। এখন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময় নানা কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হবে। জানা যায়, ঢাকার কাছেই আধুনিক সুবিধাসহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঢাকা একটি সেতুবন্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। এমন আশা থেকেই এই বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে হিসেবে পদ্মা নদীর কাছেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর আগে ২০১১ সালে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরে এটি বাতিল করে পদ্মাপারের চর জানাজাতসহ আটটি চর এলাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জায়গা চূড়ান্ত করার জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি বা প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শুরু করে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মূলত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ফ্লাইট ওঠা-নামার ক্ষেত্রে আগামী ২৫ বছরের চাহিদা বিবেচনায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের আগস্টে বিমানবন্দরটি নির্মাণ প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য কাজের জটিলতায় প্রকল্পটি আটকে ছিল।