পদ্মা সেতুতে নির্দিষ্ট সময়ে রেল চলাচল নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। চীনা অর্থায়নে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে ঋণচুক্তি হওয়ার কথা, সেটিই এখনো সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে চীনা দূতাবাসে ঋণচুক্তির কাগজপত্র পাঠানো হলেও এখনো তারা সাড়া দেয়নি। ফলে ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই রেল চলাচলের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযোগের বিষয়ে চীনের সঙ্গে শুধু ঋণচুক্তিটিই বাকি রয়ে গেছে। অন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ঋণচুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করব।’ অবশ্য রেল ছাড়া পদ্মা সেতুর অন্য অংশের নির্মাণ ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হওয়া শুরু হয়েছে। দেশের দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিপুল জনগণের অধীর আগ্রহের অবসান ঘটিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ চলছে। একদিকে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, অন্যদিকে নদীশাসনসহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ। কংক্রিট আর স্টিলের নিখুঁত গাঁথুনিতে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম এই নান্দনিক সেতুটি। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, পদ্মা সেতুর কাজ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে নিয়মমাফিক চলছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয় খুব দক্ষতার সঙ্গে মনিটর করা হচ্ছে। এটি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, যা থেকে খুব সহজেই বলে দেওয়া যায় যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়তো আর বেশি দূরে নয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে এ সেতুর কাজ। সেতুমন্ত্রী অবশ্য মূল সেতু ও রেলসেতু দুই অংশের কাজ একই সঙ্গে শেষ করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর রেলসেতুর জন্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার ২৩৯ কোটি দেওয়ার কথা রয়েছে দেশীয় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন, জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, পরামর্শক ও অন্য খাতে এ অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু চীনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে ঋণচুক্তি না হওয়ায় রেলসেতুর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিষয়টি নিয়ে ২২ নভেম্বর আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ১৬ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ওই সভার নোটিস জারি করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুুবুল হক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকে সড়কযানের পাশাপাশি ট্রেন চলাচল শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুতগতিতে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনা করে একে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জিটুজি ভিত্তিতে চীনা অর্থায়নে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এর ক্রয় প্রস্তাব ২৩ জুলাই (চলতি বছর) সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়। এ বিষয়ে চলতি বছর ৮ আগস্ট চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের (সিআরইসি) সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের কমার্শিয়াল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর ত্বরান্বিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টস অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ইআরডি থেকে ঋণচুক্তির ডকুমেন্টস বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসে পাঠানো হলেও এ বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকে সড়কযানের পাশাপাশি ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক বলে সভার নোটিসে উল্লেখ করা হয়। তবে ওই বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে সে বিষয়টি খোলাসা করেননি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক সুকুমার ভৌমিক। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘এটি তাদের ইন্টারনাল মিটিং। অর্থায়ন বিষয়ে কী হয়েছে সে সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আমার দায়িত্ব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি আমার দেখার বিষয় নয়।’ জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পটি দুই ধাপে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙ্গা থেকে নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের এই প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়ন মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয়েছে ২০১৮ সালে, যার মাধ্যমে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই রেল চলাচল শুরুর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। এদিকে গতকাল পদ্মার উভয় পারে ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মার দুই পার মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ভারী ভারী যন্ত্রপাতিসহ সেতুতে ব্যবহূত নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত ট্রাক আর জাহাজযোগে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। মূল সেতুর উপরিভাগ কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবিলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাসফর্ম। বাংলাদেশি ও সহস্রাধিক চীনা প্রকৌশলী এবং প্রায় ২০ হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক যৌথভাবে সেতুর নানা অংশে কোথাও পাইলিং, কোথাও স্প্যান জয়েন্ট, সেকশন, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকর্ড কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। নদীর মাঝে চলছে ড্রেজিংয়ের কাজ। প্রায় শেষের পথে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাজ। আর মাওয়ায় পদ্মাতীরের অদূরে ডাস্ট ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে সেতুর উপরিভাগের (স্প্যান) জয়েন্টের কাজ চলছে পুরোদমে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা, অ্যাপ্রোচ সড়ক আর স্প্যান জয়েন্টের দৃশ্য দেখে মনে হবে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন ডানা মেলে দাঁড়াতে যাচ্ছে। সেতু প্রকল্পে নিয়োজিত প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, দু-এক মাসের মধ্যে দুটি পিলারের ওপর স্প্যান-গার্ডার বসিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। তখন পদ্মার ওপরে সেতুর আকৃতি স্পষ্ট হবে। ফলে বছর শেষ হওয়ার আগেই পিলারের ওপর ভর করে দাঁড়াবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মূল সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের জন্য ৩ হাজার ৬০০ টন ওজনের ফ্লোটিং ক্রেন এবং ২ হাজার ৫০০ টন ওজনের জার্মানি হ্যামার প্রকল্প এলাকায় আনা রয়েছে। তিনি জানান, স্প্যানবাহী দুটি শিপমেন্ট চীন থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় এসেছে। সেগুলোর এখন মাওয়া ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপে জয়েন্টের কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়েছে। অন্যটির জয়েন্টের কাজ চলছে। একেকটি জয়েন্টের ওজন ৪৮ থেকে ৬০ টন। এ দুটি স্প্যানের জোড়া লাগানো কাজ শেষ হলে এর একটি মাওয়া অংশের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের এবং অন্যটি স্প্যান ৩৭ ও ৩৮-এর মাঝামাঝি বসানো হবে। প্রকল্প এলাকায় পদ্মার মধ্যে কয়েকটি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে। নতুন আরও কয়েকটি পিলারের কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর নকশার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওপরের অংশের সোনালি রঙের দুটি স্প্যানের মধ্যে ৩৪টি জয়েন্ট থাকবে। পার্কিং ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ৬টি করে মোট ২৪০টি পাইল থাকবে। আর দুই প্রান্তে আরও ১২টি করে ২৪টি পাইল থাকবে। অর্থাৎ সর্বমোট থাকবে ৬৪টি পিলার।
এদিকে মুঠোফোনে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে সব সংকট কাটিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন বাস্তব সত্য। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার সবচেয়ে বড় কঠিন চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। পদ্মার দুই পারে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। পদ্মা সেতু চালু হলে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ফেরি চলাচলের ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের অন্য জেলাগুলোর যাতায়াতব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের জন্ম নেবে। এই সেতুর কারণে বদলে যাবে বাংলাদেশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ওই সব এলাকা পরিণত হবে অর্থনৈতিক জোনে।