শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অস্থিরতার শেষ নেই রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহনে

মির্জা মেহেদী তমাল

অস্থিরতার শেষ নেই রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহনে

অস্থিরতার যেন শেষ নেই রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে। বছরের পর বছর সংকটের আবর্তে ঘুরছে সংস্থাটি। এক সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে আরেকটি। একে একে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হলেও পরিবর্তন আসেনি জাতীয় পতাকাবাহী একমাত্র আকাশ পরিবহন সংস্থাটির। হালে উড়োজাহাজের ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ বিমানযাত্রাকে বিপজ্জনক করে  তুলছে। যখন তখন বিমানের জরুরি অবতরণ যেন নিয়মিত ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহন করা নতুন উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটির পর তোলপাড় এখন সারা দেশে। এ ঘটনার পর বিমানের আরও জরুরি অবতরণের ঘটনা ফাঁস হচ্ছে। এসি নষ্ট থাকায় হজযাত্রীদের অসুস্থ হওয়ার খবরও মিলছে নতুন করে। ধামাচাপা দিয়ে রাখা এমন অতীত রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় চরম অস্থিরতা এখন বিমানে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ভিভিআইপি ফ্লাইটের ‘নাট-বোল্ট’ খুলে যাওয়ার ঘটনায় কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অদক্ষতার বিষয়টির প্রমাণ মেলায় অস্থিরতার ঢেউ লেগেছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। এমন পরিস্থিতিতে আকাশে শান্তির নীড় হয়েও বিমান নির্বিঘ্নে উড়তে পারছে না দেশ থেকে দেশান্তরে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না ভিভিআইপি ফ্লাইটেরও। তবে বিমানকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটির সঙ্গে বিমান কর্মকর্তাদের অবহেলার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বিমানকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিমানের একটি সূত্র জানায়, বিমানের দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়িতদের নতুন করে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সংস্থা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিমানের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এখন নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি সামনে রেখেই অন্য জরুরি অবতরণের ঘটনাগুলোর তদন্ত শুরু হচ্ছে। এসব ঘটনায় যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে— অবস্থান যা-ই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিমানের কোনো উন্নতি হয়নি। লোকসানেই থাকতে হচ্ছে লাভের বিমানকে। তবে উন্নতি হয়েছে কিছু বিমান কর্মকর্তা-কর্মচারীর। আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হওয়া এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। কোনো ঘটনার তদন্ত করতে গেলেই যাত্রীসাধারণকে জিম্মি করে ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে গোটা বিমানকেই অচল করে রাখেন। পাইলট থেকে শুরু করে বিমান কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যেকেই নানা সংগঠনের ব্যানারে বিমানকে অচল করে রাখার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটিয়েছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই বিমানে এখন হর্তাকর্তা। এদের শক্তি যত বাড়ছে, বিমানযাত্রা ততই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। জমির দালালি থেকে শুরু করে সোনা চোরাচালান, চুরি, নারী কেলেঙ্কারির মতো কাণ্ড ঘটালেও বিমান পাইলটদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। চোরাচালানে জড়িত চিহ্নিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যতক্ষণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা না পড়েন, ততক্ষণ বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যাপারে থাকে নিশ্চুপ। ১২৪ কেজি সোনা চোরাচালান মামলায় গ্রেফতার পাইলট বছরের পর বছর স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও স্বীকার করেছেন। অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ সংস্থার সম্মান নষ্ট হওয়ার অজুহাতে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সূত্র জানায়, বিমানের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা নতুন নয়। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট জরুরি অবতরণের পর বিষয়টি সামনে আসে। সূত্র জানায়, ওই ফ্লাইটে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই অতীতের ঘটনাগুলো সামনে চলে এসেছে। যেসব ঘটনা বিমান কর্তৃপক্ষই ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল দীর্ঘদিন। বিমানের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানের নতুন রুট মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে এ পর্যন্ত দুবার অবতরণ করতে না পেরে ফিরে আসে বিমানের ফ্লাইট। এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হলেও অভিযুক্তরা রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখিয়ে তদন্তকাজ শেষ করা হয়। এতে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাটের ব্যবস্থা হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। অপেশাদার ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সংকট, দুর্নীতি, কেনাকাটা, টেন্ডার প্রদানে অনিয়ম, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, অপচয়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে বিমান যখন ডুবতে বসে, ঠিক তখন দাবি উঠেছিল আকাশ পরিবহন ব্যবসায় পেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঢেলে সাজানোর। এই লক্ষ্যে ২০০৭ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এটিকে কোম্পানি করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি লাভেও যায়।

কিন্তু দুই বছর পরই পুরনো ধারায় ফিরে যায় বিমানের ব্যবস্থাপনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীন যাত্রা, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সবই পুনর্বহাল হয়। উপরন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, লুটপাটের মাত্রা বেড়ে যায়। মূলত কোম্পানি করার পরই লুটপাটের সঙ্গে অস্থিরতাও বাড়তে থাকে। সেই অস্থিরতা সঙ্গী করেই চলছে বিমান।

সর্বশেষ খবর