শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুই আসামি এখনো ফেরারি

মির্জা মেহেদী তমাল

দুই আসামি এখনো ফেরারি

চৌধুরী মাঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান

দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকারী দুই খুনি এখনো ফেরারি। তারা হলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর দুই নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। দুজনই বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে অপরাধীদের দেশে ফেরত আনা হলেও বুদ্ধিজীবী হন্তারক এ দুই জল্লাদকে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। ১৮ বুদ্ধিজীবীর দুই খুনিকে কবে দেশে ফেরত আনা হবে, সংশ্লিষ্টরা কেউ বলতে পারছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এদের অবস্থান সম্পর্কে সরকার অবগত। বিদেশে তারা আলিশান জীবনযাপন করছেন। তবে নানা জটিলতায় তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। তারা বিদেশে অবস্থান করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ পর্যন্ত মোট ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। কিন্তু অন্যতম দুই ঘাতককে বিদেশ থেকে না আনতে পারায় তাদের দণ্ড এখনো কার্যকর করা যায়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলাটিকে সূত্র ধরে সংস্থা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ২০১০ সালে তদন্ত শুরু করে। এক বছরের বেশি সময় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউশনের কাছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকেও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাকে। পলাতক দুই খুনি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ৪৫ বছর ধরে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সূত্র জানায়, সরকারের কাছে খবর রয়েছে, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকায়। আর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তাদের মধ্যে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন একাত্তরে ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ-এর সাংবাদিক। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান হয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। তিনি লন্ডনের টটেনহ্যাম মসজিদ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান।

তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান ছাত্রজীবনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা এ সংগঠনের হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ছিলেন ওই বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন ‘চিফ এক্সিকিউটর’ বা ‘প্রধান জল্লাদ’। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নে হাইকমান্ডের নির্দেশে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। তারা একে একে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুর বধ্যভূমিতে মরদেহ ফেলে দেন। সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দীনকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কথা হচ্ছে। আলোচনাসাপেক্ষে যে কোনো আসামিকে ফেরত দিতে পারে যে কোনো দেশ। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বন্দী বিনিময় চুক্তিও লাগে না। ফলে এখন ঢাকা-লন্ডনের আলোচনার ওপরই নির্ভর করবে চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের ফেরতের বিষয়টি।

মামলা ধামাচাপা : ইতিপূর্বে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলা পরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান হন্তারক বলে আলোচিত আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামানকে। কিন্তু মামলার তদন্ত শুরু হতে না হতেই তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হত্যা, অপহরণ ও ষড়যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও আইনের ভুল ধারায় মামলা হয়েছে— এই কারণ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলাটির অপমৃত্যু ঘটানো হয়। শহীদ গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০(খ)/৪৪৮/৩৬৪/৩০২/২০১/৩৪/১১৪ ধারায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে। বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় ২০০২ সালে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এভাবেই পার পেয়ে যান ঘাতকরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের পর একে একে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন এই দুই ঘাতক।

মামলার রায় : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এরপর ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আরেক মামলায় একই ট্রাইব্যুনাল মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আর গত বছর ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এদের মধ্যে নিজামী ও মুজাহিদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগসংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন এ-দেশীয় চারজন। তারা হলেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, ’৭১-এর গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর কমান্ডার চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, ’৭১ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। আলবদর ও রাজাকাররা সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিত। আর বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করত। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করতেন নিজামী ও মুজাহিদ। আর আলবদর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। একাত্তরে ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কসাই’ নামে পরিচিত আশরাফুজ্জামান ছিলেন ঘাতক বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ আর মাঈনুদ্দীন ছিলেন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে মাঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তারা দুজনই সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এজন্য তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা কঠিন হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর