রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরিকল্পনা ছিল আত্মঘাতী হামলার

সিলেটের সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে আশকোনার সূর্য ভিলা

মির্জা মেহেদী তমাল

পরিকল্পনা ছিল আত্মঘাতী হামলার

আশকোনার সূর্য ভিলা নামে এই বাড়িতে আস্তানা গড়ে জঙ্গিরা। গতকাল অভিযান চলাকালে রাস্তায় মানুষের ভিড় —জয়ীতা রায়

দুপুর ১২টা ২৩ মিনিট। ঢাকার আশকোনার পূর্বপাড়ার ৫০ নং বাসার চারদিক ঘিরে আছে প্রচুর পুলিশ। সবার দৃষ্টি ওই বাসার নিচতলার দিকে। সেদিকেই তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলগুলো তাক করা। উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা চারদিকে। পুলিশের এক কর্মকর্তা হ্যান্ড মাইকে আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানাচ্ছেন। হঠাৎ আত্মঘাতী হামলার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাড়ির ভিতর থেকে বোরকা পরা এক নারী বেরিয়ে আসেন। বাম হাতে ধরা একটি শিশুকে নিয়ে ধীর পায়ে পার্কিং পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। চারদিকে হঠাৎ নীরবতা। পুলিশও তখন পজিশনে। হঠাৎ ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করলেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। বোরকা পরা নারী একটু থামলেন। ডান হাত একবার উঁচু করেই আবারও নামিয়ে ফেললেন। নারীটি এবার একটু পিছিয়ে যান। পার্কিংয়ের সামনের একটি কক্ষের কাছে তিনি পৌঁছান। ঠিক তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ! কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুলিশের দল নিরাপদে একটু পিছু হটলেন। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পার্কিং ঘর। ধোঁয়া একটু পরিষ্কার হয়। তখনই চোখে পড়ে সেই নারীটিকে। পড়ে আছে একটু কাত হয়ে। পেট চিড়ে বেরুচ্ছে রক্ত। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। পাশেই কাতরাচ্ছে শিশুটি। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

গতকাল আশকোনায় ঠিক এভাবেই নিজ শরীরে বাঁধা ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রকাশ্যে আত্মাহুতি দেন নারী জঙ্গি সারিকা। শরীরে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বেঁধে বিস্ফোরণের মাধ্যমে মৃত্যুবরণের ঘটনা দেশে এবারই প্রথম। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এভাবে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বেঁধে জীবন দেওয়ার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এর আগে সকালে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওই আস্তানা থেকে দুটি শিশু নিয়ে আত্মসমর্পণ করে আরও দুই নারী জঙ্গি শিলা আর তৃষ্ণা। এই তিন নারী প্রশিক্ষিত সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। এ ছাড়া ঘরের ভিতর পড়ে আছে আরও এক কিশোরের লাশ। পুলিশ বলছে, সে আজিমপুরে নিহত জঙ্গি নেতা কাদেরির ছেলে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ছেলেও আত্মঘাতী হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। লাশ উদ্ধারের আগে তার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, দেশে আত্মঘাতী হামলার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা আঁটছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ধারা ‘নিউ জেএমবি’। আর এ জন্য নারী জঙ্গিরা ছিল প্রস্তুত। আশকোনার ওই আস্তানায় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও গ্রেনেড মজুদ রয়েছে। শক্তিশালী গ্রেনেড দিয়ে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ তৈরি করা হতো ওই আস্তানায়। এ কারণে ওই আস্তানা থেকে সারিকার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এখনো। আজ লাশ সেখান থেকে উদ্ধার করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এরা ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন থেকে শুরু করে থার্টি ফার্স্ট নাইটকে টার্গেট করে এগোচ্ছিল। সূত্র জানায়, এদের হামলা আগের সব হামলার চেয়ে ভয়ঙ্কর হতো।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানোর একপর্যায়ে হঠাৎ সুমনের স্ত্রী শারিকা শিশু সন্তানসহ বেরিয়ে আসার কথা জানায়। এ সময় তার গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা ছিল। ভেস্টের মধ্যে তাজা গ্রেনেড ছিল। পুলিশ তাকে ওই ভেস্ট খুলে আসার জন্য বলে। কিন্তু শাকিরা ভিতরে গিয়ে আবার বেরিয়ে আসে। একপর্যায়ে সুইসাইডাল ভেস্টের সুইচ টিপ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ভিতরে আরও সুইডাইডাল ভেস্ট থাকতে পারে বলেও সিটিটিসির কর্মকর্তাদের আশঙ্কা।

সুইসাইডাল ভেস্ট : সূত্র জানায়, সুইসাইডাল ভেস্ট দেখতে ফতুয়া বা হাতাকাটা গেঞ্জির মতো এক ধরনের পোশাক। যা জঙ্গি-সন্ত্রাসী আত্মঘাতী হামলা চালাতে ব্যবহার করে। আত্মঘাতী হামলা চালানোর সব ধরনের উপকরণ থাকে এই পোশাকের মধ্যে। এমন ভেস্ট পরেই আত্মঘাতী হয় নারী জঙ্গি শারিকা। এর আগে আরও কয়েকটি জঙ্গি আস্তানা থেকে এমন বেশ কয়েকটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

‘সূর্য দীঘল থেকে সূর্য ভিলা’ : সিলেটের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ থেকে ঢাকার আশকোনার ‘সূর্য ভিলা’। মাঝে রয়েছে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান, কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিং খ্যাত ‘তাজ মঞ্জিল’ এবং নারায়ণগঞ্জের ‘দেওয়ানবাড়ি’। ভয়ঙ্কর সব জঙ্গির পতন ঘটায় আলোচনায় উঠে আসে এসব ভবন, যেখানে আস্তানা গেড়েছিল দেশের শীর্ষ জঙ্গিরা। এর মধ্যে সুইসাইডাল স্কোয়াডের নারী জঙ্গিও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সশস্ত্র অভিযানে এ ভবনগুলোতেই পতন ঘটে ভয়ঙ্কর সব জঙ্গির। এক সময় এ ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের বোমা হামলায় কেঁপেছে বাংলাদেশ। তাদের হাতে নৃশংস খুনের শিকার হয়েছেন ১৭ বিদেশিসহ শতাধিক মানুষ। নিহতদের মধ্যে আরও রয়েছেন বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। সর্বশেষ গতকাল আশকোনায় পতন ঘটল এক আত্মঘাতী নারী জঙ্গির।

সূর্য দীঘল বাড়ি : জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই বাগমারায় আস্তানা গেড়ে সারা দেশে এ জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। তাদের নির্দেশে দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা, গাছে ঝুলিয়ে মানুষ পিটিয়ে হত্যা, বিচারকদের ওপর আত্মঘাতী হামলাসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয় জেএমবি। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে গোয়েন্দারা এই দুই কুখ্যাত জঙ্গিকে ট্র্যাক করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সিলেট নগরীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’তে শায়খ আবদুর রহমান ও তার সঙ্গীরা লুকিয়ে আছেন বলে খবর পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমানকে জীবিত গ্রেফতার করতে অভিযান চালাতে হয় দীর্ঘ ৩১ ঘণ্টা। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর ওই বছরের ২ মার্চ সকাল সোয়া ৭টায় দেশের মোস্ট ওয়ান্টেড শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ রহমান আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। এর ঠিক চার দিন পর ৬ মার্চ জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার চেচুয়ার রামপুর থেকে র‍্যাব-৯ সদস্যরা গ্রেফতার করে। বিচার শেষে ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ জেএমবির শীর্ষ ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

গুলশান আর্টিজান : ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা হামলা চালায়। তারা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া তাদের হামলায় নিহত হন আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা। রাতভর পুলিশের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ অভিযানে পতন ঘটে ছয় জঙ্গির। এর কয়েক দিন পর শোলাকিয়ায় পবিত্র ঈদের দিন একই কায়দায় জঙ্গিরা হামলা চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সেখানেও মারা যান দুই পুলিশ। নিহত হয় এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি।

জাহাজ বিল্ডিং খ্যাত তাজমঞ্জিল : ২৫ জুলাই দিবাগত রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজ বিল্ডিং খ্যাত তাজ মঞ্জিলের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশ, র‍্যাব, ডিবি, সোয়াতের যৌথ অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। ‘স্টর্ম-২৬’ নামের এ অভিযান চলাকালে বৃষ্টির মতো গুলি ও বোমা বিস্ফোরিত হয়। মূল অভিযান চলে ভোর ৫টা ৫০ মিনিট থেকে ৬টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত।

সর্বশেষ খবর