নারী নির্যাতনের ঘটনা ২০১৬ সালে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন যৌন নির্যাতন ও হয়রানি বিশেষ করে ধর্ষণ ও ইভ টিজিং ঘটনায় বাংলাদেশ বিদায়ী বছরে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো জনমনে বেশ উদ্বেগ ও ক্ষোভ তৈরি করে। এ সময় বখাটেরা শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর ওপরই নির্যাতন করেনি, ছোট শিশুদের ওপরও চালায় লোমহর্ষক নির্যাতন। নির্যাতনের পর ভিকটিমদের অনেককেই আবার নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। বখাটেরা প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডও ঘটায়।
শহর কিংবা গ্রামে সব জায়গাতেই নারী, তরুণী ও কিশোরীরা আগের চেয়ে বখাটেদের বেপরোয়া আচরণের শিকার এখন বেশি হচ্ছে। লজ্জায় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে অনেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখছে। আবার অনেকেই এই মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কেউ আবার আত্মহত্যা করছে। আবার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অনেকেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কেউবা দুর্বৃত্তের নৃশংস হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে। বখাটের ছুড়ে দেওয়া এসিডে ঝলসে যাচ্ছে কারও দেহ। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট গণধর্ষণের শিকার হয় ১০৮ জন নারী ও শিশু এবং ধর্ষণের শিকার হয় ২৩৪ নারী। আর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মোট ৩৬৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৮ জনকে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বখাটেদের উত্ত্যক্ততার শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী স্কুল-কলেজের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত স্কুল ও প্রাইভেট পড়তে আসা-যাওয়ার সময় মেয়েরা বেশি উত্ত্যক্ততার শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিভাবকদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। তাদের কন্যাসন্তানকে কেউ উত্ত্যক্ত করছে কিনা এ বিষয়ে মেয়ে সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়া এই বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কেও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যৌন হয়রানির ঘটনা সন্ত্রাসের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা অতি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ঢাকা ও তার বাইরে নারী ও কিশোরীরা কোথাও নিরাপদে নেই। অথচ নারীদের কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের প্রদত্ত দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে অভিযোগ কমিটি গঠন করার বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি এখনো আমলে নিচ্ছে না। চলতি বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে আছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু (১৯) হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তনুর মরদেহের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে ফরেনসিক রিপোর্টে গণধষর্ণের আলামত পাওয়া গেছে বলে জানায় কুমিল্লা সিআইডি কর্তৃপক্ষ। গত ১৮ অক্টোবর পাবর্তীপুর উপজেলার জমিরহাট গ্রামে পাঁচ বছরের এক শিশু সাইফুল ইসলাম নামের এক দুর্বৃত্ত দ্বারা নির্মম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর আগে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক জখম করে ওবায়দুল খান নামের আরেক বখাটে। এতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিশার মৃত্যু হয়। রিশাকে দীর্ঘদিন ধরে মোবাইলে ও স্কুলে যাওয়া-আসার পথে উত্ত্যক্ত করে আসছিল এই বখাটে। তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অবশেষে গত ২৪ আগস্ট রিশার পরীক্ষা শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে স্কুলের সামনেই ওবায়দুল রিশাকে ছুরিকাঘাত করে। এ ছাড়া প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সিলেট ছাত্রলীগের এক নেতার চাপাতির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম। গত ২৭ মে কনিকা ঘোষ (১৫) নামের দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রী আবদুল মালেক নামে এক বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। কনিকা শিক্ষকের বাসায় প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে এই নির্মম ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনায় কনিকার সঙ্গে তার আরও তিন সহপাঠীও গুরুতর আহত হয়। এ ছাড়া রাজধানীর বিসিআইসি কলেজের দুই ছাত্রীকে পিটিয়ে আহত করে স্থানীয় বখাটেরা। এতে এক ছাত্রীর পা ভেঙে যায়। সেই ছাত্রীরা জানায়, কলেজ ছুটির পর এই বখাটেরা তাদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। তবে তাদের ওপর হামলার দিন এর প্রতিবাদ করায় তাদের বাঁশ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এমনকি চলতি বছর চলন্ত পরিবহনেও নারী গণধর্ষণের শিকার হন। টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি বাসে এক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই বেড়েছে যে, বিদায়ী বছরে নারীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়েও গণধর্ষণ করা হয়। লক্ষ্মীপুরে কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জে দুই বোনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, আমরা যতই উন্নয়ন করি না কেন সমাজে নারীদের নিরাপত্তা না থাকা প্রমাণ করছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগে একজন নারীর সঙ্গে শিশু থাকলে তাদের নিরাপদ বলে মনে করা হতো কিন্তু এখন মা ও তার কন্যাসন্তান উভয়ই অনিরাপদ। নিরাপত্তাহীনতায় আছেন বৃদ্ধারাও। অর্থাৎ নারী মাত্রই অনিরাপদ।