চলতি ইংরেজি বর্ষের শেষ দিন আজ। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো আজ নানা বর্ণে, নানা আবহে ছায়াপাত করবে দেশের মানুষের চিত্তদর্পণে। কী চেয়েছি আর কী পেলাম, চিরায়ত এ মূল্যায়ন তো আছেই, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ-তৃপ্তি-বেদনার কত বিচিত্র সুর বাজবে মানবমনে। এভাবেই একটি প্রহর যাবে আর সূর্যটাও ঢলে পড়তে থাকবে পশ্চিমে। বছরের শেষ সূর্যাস্ত আজ। বিদায় ২০১৬। সব বছরের মতো এ বছরও বিশ্বময় ঘটেছে মনে দাগ কাটা ঘটনা। এসব ঘটনার অনেকগুলো সামনের বছরগুলোয়ও স্মরণীয় হয়ে রবে। দেশ-বিদেশের ঘটনাবলি প্রভাবিত করবে রাষ্ট্রাচার ও জনজীবনে। ১ জুলাই ঢাকায় হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা যেভাবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে উদ্বেলিত ও বিচলিত করেছিল, তেমনটি আগে কখনো ঘটেনি। জাতি সেই দুরাচারকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। এই দৃঢ়তা হবে প্রেরণার উৎস। বছরটি বাংলাদেশের দারিদ্রমোচন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এনেছে তাত্পর্যময় সাফল্য। ফলত দেশে এখন অতিদরিদ্রের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ভুটান, পাকিস্তান ও ভারতকে পেছনে ফেলেই এ অর্জন। এরই পাশাপাশি এক পীড়াদায়ক ব্যাপার ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি যাওয়া। হ্যাকারদের এই দস্যুপনায় স্তম্ভিত হয়েছে দেশবাসী। দেশের বিজ্ঞানী— রুবাব খান, সেলিম শাহরিয়ার, দীপঙ্কর তালুকদার, সাইফ সালাহউদ্দিন, তামজিদুল হক ও মিরাতুল মোহামিদ খান মুকিত তাদের উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছেন দুনিয়াকে। বয়ে এনেছেন দেশের জন্য সম্মান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অসামান্য সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন ক্রিকেটার মাশরাফি। সাইপ্রাসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের মেজর জেনারেল হুমায়ুন কবির। জাতীয় পরিচয়পত্র স্মার্টকার্ডভিত্তিক করা শুরু হয়েছে অক্টোবরে। মেট্রোরেল নির্মাণের সূচনা, জুনে দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের বাংলাদেশ অংশের কাজ সমাপন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই, সেপ্টেম্বরে নৌবাহিনীর জন্য দুটি ডুবোজাহাজ সংগ্রহ— ইতিবাচক এসব ঘটনার বিপরীতে যেন উপদ্রব হয়েই এসে পড়ল রোহিঙ্গা সংকট। মাত্রাধিক জনসংখ্যার চাপে জর্জর বাংলাদেশের ওপর প্রায় ৩৫ বছর ধরে ৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী জেঁকে বসে আছে। এখন মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রোহিঙ্গারা আবার দলে দলে এ দেশে ঢুকছে। সন্ত্রাসী ও আইএস নামক জঙ্গিবাদীদের নৃশংসতায় সিরিয়া ও ইরাক ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছুটছে ইউরোপের নানা দেশে। যথাযথ ঠাঁই তারা পাচ্ছে না। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরায়েল নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়ছে ফিলিস্তিনে। মানবতার এসব বিপর্যয় ছাপিয়ে চমকরূপে আবির্ভূত ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি অনেকের দৃষ্টিতে ‘ভোটে নির্বাচিত দানব’। গণভোটে জিতে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও বিশ্বকে করেছে বিচলিত। বিশ্ব এ বছর হারিয়েছে কিংবদন্তির বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোকে। আমরা হারালাম আমাদের দুই সাহিত্যপ্রতিভা সৈয়দ শামসুল হক ও শহীদ কাদরীকে। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আর থাই রাজা ভুমিবলের মৃত্যুও বেদনার্ত করেছে মানুষের অন্তর। খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর বাংলাদেশ উৎপাদন দ্বিগুণ করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে এ বছর। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গৃহায়ণ ক্ষেত্রে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল এ বছর। সাফল্য-ব্যর্থতার বিশ্লেষণে আর আশাবাদী চেতনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতো এ দেশের মানুষও ২০১৬-কে নেড়েচেড়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আজ শেষবারের মতো দেখবে। দেখতে দেখতে এসে পড়বে নতুন বছরের প্রথম দিনের প্রথম প্রহর। সেই প্রহরটি হোক তমসাহর উল্লাসময়— এই প্রত্যাশায় আজ বিদায় ২০১৬!