সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আবার মোটরসাইকেলে খুনি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গাইবান্ধা প্রতিনিধি

আবার মোটরসাইকেলে খুনি

এমপি লিটন হত্যার প্রতিবাদে ডাকা হরতালে গতকাল সুন্দরগঞ্জ জুড়ে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া টহল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

এমপি লিটন হত্যাকাণ্ড আতঙ্ক তৈরি করছে। এ খুনের সঙ্গে অতীতে মোটরসাইকেলে করে এসে নাশকতামূলক তত্পরতা চালানো গ্রুপ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খুনের মোটিভ নিয়ে কাজ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। প্রাথমিকভাবে আলামতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তদন্তকারী সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে প্রশিক্ষিত তিন সদস্যের হেলমেট পরিহিত খুনি এমপি হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এ ঘটনা ঘিরে এখনো সুন্দরগঞ্জে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

শনিবার সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের সাহাবাজ গ্রামের নিজ বাসার ড্রয়িং রুমে খুন হন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। তাকে গুলি করে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায় হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘাতকের বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে তার বুক। গতকাল সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান নারায়ণ চন্দ্র সাহা সাংবাদিকদের বলেন, লিটনের বুকের ডান দিক দিয়ে একটি গুলি ঢুকে বেরিয়ে গেছে। শরীরের ভিতর থেকে যাওয়া আরেকটি গুলি বের করা হয়েছে। এ ছাড়া তার বাঁ হাতেও তিনটি গুলি লেগেছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে ইতিপূর্বে মোটরসাইকেলে করে এসে হেলমেট পরা খুনিরা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বেশ কয়েকটি। এক মোটরসাইকেলে থাকে তিন খুনি। শিকারের খোঁজে অবিরাম ঘুরে বেড়ায় তারা। এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। পথে চলতে চলতেই তাদের অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। জনাকীর্ণ স্থানগুলোয় একই স্টাইলে একের পর এক লাশ ফেলে মুহূর্তে তারা লাপাত্তা! নজিরবিহীন নিরাপত্তা-বেষ্টনী গড়ে তুলেও এদের রোধ করা যায়নি রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায়। এক মোটরসাইকেলে করে আসা তিন খুনি ইতিপূর্বে হত্যা করেছে দুই বিদেশি নাগরিক, মসজিদের মুয়াজ্জিন, পুলিশ সদস্য, পঞ্চগড়ে একজন পুরোহিত এবং সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দলের এমপি লিটনকে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই প্রশাসনযন্ত্র নড়েচড়ে ওঠে। শুরু হয় ছোটাছুটি। কিন্তু খুনিদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না তারা। হত্যাকারীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশিক্ষিত র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা, ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরও মোটরসাইকেল আরোহী তিন খুনির সন্ধানে মাঠে নেমে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। পুলিশ একসময় নিশ্চিত হয় যে, উগ্রপন্থিরাই এমন ভয়ঙ্কর কাজে জড়িত। এমপি লিটনের খুনের ঘটনার গতি-প্রকৃতিও প্রায় একই ধরনের। এর পেছনে উগ্রপন্থিরা জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে হামলাকারী চারজনকেই প্রশিক্ষিত কিলার বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এমপি লিটনের খুনিরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির এটা নিশ্চিত। শরীরের কোন অংশে আঘাত বা গুলি চালালে মিশন শতভাগ সফল হবে তা ভালোভাবে তারা জানে। এসব কাজ বিশেষ প্রশিক্ষিত কিলাররা করছে বলে নিশ্চিত হলেও এরা কারা তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন মাঠে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমপি লিটনের শ্যালক বেদারুল আহসান বেতার ও বাড়িতে থাকা কর্মচারী জুয়েল মিয়া জানান, ২৯ ডিসেম্বর রাতে এমপি লিটন ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। শনিবার বিকালে তিনি তার বৈঠকখানার ঘরে টেলিভিশন দেখছিলেন। হঠাৎ করে মোটরসাইকেলে করে তিন যুবক বাড়িতে আসে। ওই যুবকরা হেলমেট পরা ছিল। একজন মোটরসাইকেল নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজন বরান্দায় এসে এমপি লিটনের অবস্থান জানতে চায়। পরে তিনি ঘরে আছেন বুঝতে পেরে দুই যুবক ঘরের দরজা খুলেই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এরপর তারা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। বেদারুল আহসান বেতার বলেন, ‘হামলার সময় এমপি চিৎকার করে বলতে থাকেন, “আমাকে গুলি করেছে, আমাকে বাঁচাও, ওদেরকে ধর।” আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি, তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছেন আর দুর্বৃত্তরা দ্রুত গুলি করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে এমপি লিটনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঘটনার পর এমপি লিটনের গ্রাম সাহাবাজ (মাস্টারপাড়া), সর্বানন্দ, বামনডাঙ্গাসহ গোটা সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় নেমে এসেছে শোক ও আতঙ্কের ছায়া। নিজ বাড়িতে লিটনকে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীও। নেতা-কর্মী ও স্থানীয় জনগণের দাবি, দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর করা হোক। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এমপি লিটনের বাড়িসহ বামনডাঙ্গা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। এসব জায়গায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসহ বিভিন্ন সড়কের মোড়ে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই অঞ্চলটি জামায়াত-অধ্যুষিত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকে সেখানে বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। এমপি লিটনই তখন সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন। আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি,  সে কারণে গাইবান্ধায় লিটন জঙ্গি-জামায়াতের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন।’ সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় রংপুর পুলিশ রেঞ্জের বিভাগীয় কমিশনার (ডিইআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। শনিবার রাত ১০টার দিকে তিনি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাহাবাজ গ্রামের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনের বাড়িতে যান। এ সময় তিনি এমপি লিটনের গুলিবিদ্ধ হওয়া ঘর দেখেন এবং সেখানে পড়ে থাকা গুলির খোসা, পানের বাটা, মোবাইল ফোনসহ আলামত দেখেন। এমপি লিটনের বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলতে থাকা ১২ বছরের এক কিশোরসহ ওই বাড়ির লোকজন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বর্ণনা শোনেন। এ সময় রংপুর পুলিশ রেঞ্জের বিভাগীয় কমিশনার (ডিইআইজি) বশির আহম্মেদের সঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আশরাফুল আলম (বিপিএম), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল্লাহ আল ফারুক, সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুল আলমসহ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর