মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংলাপের পরই সার্চ কমিটি

২২ দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ, কাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসছেন রাষ্ট্রপতি, বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ ৯ ফেব্রুয়ারি

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

সংলাপের পরই সার্চ কমিটি

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আছে মাত্র ২৯ দিন। ৯ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেবেন তারা। আসবে নতুন কমিশন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যে ২২টি দলের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। কাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা। সংলাপ শেষ করে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের ‘নামের সুপারিশ’ তৈরি করতে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করা হতে পারে। এর আগেও ২০১২ সালে ইসি নিয়োগের ১৪ দিন আগে সার্চ কমিটি করা হয়েছিল। বর্তমান ইসি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এবারে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়াতে চাইছে না সরকারও। নিষ্কলুষ ভাবচ্ছবির লোকদের ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপিসহ কয়েকটি দল তাদের পছন্দের ‘নির্বাচন কমিশনারদের’ নামের তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি ‘নির্বাচন কমিশনার’ হতে পারেন এমন ১০ জনের নাম প্রস্তাবের পাশাপাশি সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন, তাদের নামও রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলই এখন আশাবাদী। সবারই প্রত্যাশা, রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ হবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ। সূত্র জানিয়েছে, বিগত ইসি গঠনের নিয়ম অনুসরণ করেই এবারও সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। রাষ্ট্রপতি কাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসবেন। আওয়ামী লীগের পরে অন্য কোনো দলের সঙ্গে সংলাপ করার সূচি নেই। বিগত ইসি গঠনের সময়ও রাষ্ট্রপতি বিএনপিসহ ২৩টি দলের মতামত নিয়েছিলেন। জানা গেছে, সার্চ কমিটি গঠনের পরে যে সব দল ‘নতুন কমিশনের’ জন্য নাম প্রস্তাব করেননি তাদের কাছে আবারো নাম তালিকা চাওয়া হতে পারে। এরপর সব দলের প্রস্তাবিত নাম তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ইসি গঠনে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম সুপারিশ করা হবে।

সবার চোখ এখন নির্বাচন কমিশনের দিকে। সর্বত্রে আলাপ-আলোচনা চলছে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে। নির্বাচন  কমিশনে কারা আসছেন, চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের বিদায়ের পর আসবে নতুন কমিশন। আগামী নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে সবখানেই চলছে আলাপ-আলোচনা। এমনকি ‘নবম সংসদ নির্বাচন’ বর্জনকারী দল বিএনপিও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে থাকলেও গত চার দশকেরও বেশি সময়ে তা আর হয়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধানও রাখার প্রস্তাব এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ (১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারও আগের প্রক্রিয়ায় ইসি নিয়োগ হবে। ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই হবে। রাষ্ট্রপতি যথাসময়ে সংবিধান অনুসারে ইসি নিয়োগ দেবেন।

২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারককে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হন হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান। এর আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অধিকাংশ দলই সার্চ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। ইসি গঠন নিয়ে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপসহ ২৩টি দলের মতামত নেন রাষ্ট্রপতি। এ সংলাপে অধিকাংশ দলই সংবিধান অনুসারে সিইসি ও ইসি নিয়োগে আলাদা আইন করা বা অনুসন্ধন কমিটির পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি কোনো নাম দেয়নি। ওই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরদিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে।

বিদায় নিতে প্রস্তুত ইসি : নির্বাচন কমিশনে চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায় নিতে হবে বর্তমান কমিশনকে। ইতিমধ্যে নিজ নিজ ফাইলপত্র গোছানো শুরু করেছেন কমিশনাররা। বিগত পাঁচ বছরেই নানামুখী সংকটে ছিল নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে বিদায়ের আগে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকেও অব্যাহতি পায় বর্তমান ইসি। তবে বছরের শেষ মাসে এসে কিছুটা প্রশংসা কুড়িয়ে বিদায় নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে আচরণবিধি লঙ্ঘন, হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে পৌরসভা ভোট শেষ করে। এরপর অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের ভোটও করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় দখল-সংঘর্ষ ও শতাধিক প্রাণহানির মধ্যে শেষ হয় দলীয় প্রতীকে ইউপি ভোট। সব মিলে নানা বিতর্কের মুখে বছর শেষ হলেও বিদায়ের আগমুহূর্তে ডিসেম্বরে এসে সবার সহযোগিতায় দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোট করে শান্তিপূর্ণভাবে; যা নিয়ে সব মহলে প্রশংসা কুড়ায় ইসি। সেই সঙ্গে এ নির্বাচনকে দৃষ্টান্তমূলক বলে মত দেন পর্যবেক্ষকরাও। একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কাল আওয়ামী লীগের সংলাপ : রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল বিকালে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এবার নির্বাচন কমিশন গঠনে আওয়ামী লীগ আইন করার প্রস্তাব দিলেও তা এবার করা হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের মধ্যে থেকে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আওয়ামী লীগ তাই মেনে নেবে বলে জানা গেছে। নতুন ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কাল ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসবেন তিনি।

এদিকে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।’ সে অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন রাষ্ট্রপতি। তাই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে বিশেষ কোনো প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তাও মনে করছেন না দলটির নীতিনির্ধারকরা। তবে সংলাপে অংশ নিয়ে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির যে কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন থাকার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে তারা জানান। সংলাপের জন্য প্রস্তাব তৈরি করতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন। তার কাছে প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা চলছে। আমরা নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে মোটামুটিভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর দায়িত্ব দেব। তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।’ তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে একটা আইন করার কথা উঠেছে। কিন্ত এ আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় হাতে নেই। তাই সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্রপতি আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের সব পদক্ষেপ নেবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর