বর্তমানে টাঁকশালে যেসব মেশিনে টাকা ছাপানো হয়, এগুলো প্রায় ৩০ বছরের পুরনো। ফলে উৎপাদিত টাকার ছাপা স্পষ্ট হয় না অনেক ক্ষেত্রে। এ সমস্যা সমাধানে গাজীপুরে অবস্থিত টাঁকশালে (দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিমিটিড) নতুন চারটি ডিজিটাল মেশিন স্থাপন করা হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদেন, ২০১৬-তে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের এমডি জিয়াউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের অর্থনীতিবড় হচ্ছে। টাকার চাহিদাও বাড়ছে। অথচ প্রায় ত্রিশ বছর আগে স্থাপিত মেশিনগুলো দিন দিন পুরনো হচ্ছে, ঘন ঘন মেরামত করতে হচ্ছে। এর ফলে মেশিন বন্ধ থাকছে এবং উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের যৌথ উদ্যোগে চারটি মেশিন কেনা হয়েছে। এই মেশিনগুলো উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ছাপানো সম্ভব হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। যে চারটি মেশিন কেনা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে শিট ফেড রোটারি নাম্বারিং অ্যান্ড সিগনেচার প্রিন্টিং মেশিন, স্পার্ক সংযোজনের প্রিন্টিং মেশিন, অপসেট প্রিন্টিং মেশিন ও সুপার অরলফ ইন্টাগলিও প্রিন্টিং মেশিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে সুইজারল্যান্ডের কেবিএ নোটাশিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই মেশিনগুলো সরবরাহ করছে। এমডি জানান, এই মেশিনগুলোর প্রতিটির সঙ্গে কম্পিউটার যুক্ত থাকবে। ফলে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সরবরাহকারী কোম্পানির প্রকৌশলীরা সেখানে বসেই এর সমাধান করতে পারবেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নোট ছাপানোর যে চাহিদা দেয় তা পূরণ করার জন্য দুই শিফটে কাজ চালু রয়েছে। প্রয়োজনীয় মেশিন ক্রয়ের পাশাপাশি টাঁকশালের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণের জন্য পৃথক একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রচেষ্টায় আমদানিনির্ভর কয়েকটি আইটেম যেমন : এনভেলাপের সিল ফ্লাপ গাম, ওভাল পাঞ্চ গবেষণাগারে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের এমডি জানান, বিশ্বে যে ৬৫টি নোট মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা আমাদের মতো এত কম মেশিন নিয়ে এত বেশি উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারেনি। টাঁকশালে টাকা ছাপানোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার নিয়ে করপোরেশনের অর্থায়নে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। রয়েছে মসজিদ ও খেলার মাঠ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় রয়েছে ৭৯টি সিসিটিভি ক্যামেরা যা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করা হয়।নতুন ছাপায় আসছে বড় তিন নোট : বর্তমানে ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার যে নোটগুলো বাজারে প্রচলিত তার ছাপা ও রং কিছুটা অস্পষ্ট। পুরনো মেশিনের কারণে যথাযথ রং ও ডিজাইন ফুটে উঠছে না। ফলে ডিজিটাল মেশিনগুলো সংস্থাপনের পর ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকা নোটের রং ডিজাইনে কোনো পরিবর্তন না এনে আরও স্পষ্টিকরণ করা হবে। নোটগুলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ছবি আছে সেটিও আরও যথোপযুক্ত (অ্যাকুরেট) হবে বলে জানিয়েছেন টাঁকশালের এমডি। দেশের টাকা দেশে ছাপানোর লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের এপ্রিলে গাজীপুরে ৬৬ দশমিক ৫২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। টাকা ছাপানোর কাজ শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৯ সালে এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ছাপিয়ে আসছে। ১৯৯২ সালে ১০০ কোটি টাকার অনুমোদিত ও ৫০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের বর্তমান নিট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ টাকা থেকে এক হাজার পর্যন্ত ব্যাংক ও কারেন্সি নোট মিলিয়ে প্রায় ৯০ কোটি পিস টাকা উৎপাদন করে। টাঁকশালে শুধু যে টাকা ছাপা হয় তাই নয়, স্মারক ডাক টিকেট, রাজস্ব টিকেট, পোস্ট কার্ড, বিড়ি ব্যান্ড রোল, সিগারেট ব্যান্ড, ব্যাংকের চেক পাতা, সার্টিফিকেট, জিএসপি ফরমসহ ১৯ ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়। আর এসব ছাপিয়ে গত অর্থবছরে ২৪৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে আগের অর্থবছরে মুনাফা ছিল ২৩১ কোটি টাকা। তবে টাকাসহ এসব পণ্য ছাপানোর কাজটি করতে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। গোপনীয়তা বজায় রেখে কাঁচামাল আনতে হয় দেশের বাইরে থেকে। এমডি জিয়াউদ্দিন আহমদ জানান, আগামী মাসেই তার অবসরে যাওয়ার কথা। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আসার পর টাঁকশালের উন্নয়নে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার।